তা হলে উঠ, দু’জনে অজু করে আসি।
সালেহা তাহাজ্জুদের নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আর আসমা তাহাজ্জুদ নামাযের পর এস্তেখারার নামায পড়ে আল্লাহর কাছে কী করবে না করবে জানার জন্য কেঁদে কেঁদে দোয়া। করে ঘুমাল।
সালেহা এস্তেখারার নামাযের সম্বন্ধে জানে। তাই সকালে ফযরের নামায পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করার সময় বুবুকে জিজ্ঞেস করল, স্বপ্ন দেখেছিলে?
আসমা বলল, না। তারপর বলল, পর পর সাত রাত পড়ার নিয়ম। এর মধ্যে আল্লাহ স্বপ্নে জানিয়ে দেবেন।
তিন রাত পড়ার পর আসমা স্বপ্নে দেখল, রিয়াজুলের মা-বাবা ও ছোট চাচা তাদের বাড়িতে এসে যখন বিয়ের দিন ঠিক করার কথাবার্তা বলছেন তখন রিয়াজুল ছিল না। হঠাৎ সেই সময় মনোয়ার হোসেন চাচা এসে বললেন, তোমরা বিয়ের দিন ঠিক করছ, আর ওদিকে রিয়াজুলকে কারা খুন করেছে। এই কথা শুনে আসমা চমকে উঠল। সেই সাথে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তারপর বাকি রাতটা ভয়ে সে ঘুমাতে পারল না। কেঁদে কেঁদে ফজর করল। ফজরের নামায পড়ে আল্লাহকে জানাল, হে রহমানুর রহিম, স্বপ্নের দ্বারা এ কেমন ইশারা করলে? রিয়াজুল ভাইয়ের তুমি হায়াৎ দারাজ কর। তার হায়াৎ না থাকলে আমার হায়াৎ তাকে দাও। তার বদলে আমাকে তুমি দুনিয়া থেকে তুলে নাও।
আসমারা যেদিন বাড়ি ফিরে আসে সেদিন সকালে মতি নানার অসুখের কথা শুনে তাকে দেখার জন্য সোনাহাটা গিয়েছিল। তিনদিন পরে আজ ফিরে এসে তাদের আসার কথা জানতে পেরে দেখা করতে গেল।
মোসারেফ হোসেন বারান্দায় বসেছিলেন। মতিকে দেখে বললেন, এস বাবা এস। আমরা তো তিন দিন হল ফিরেছি। তুমি আসনি কেন?
মতি সালাম দিয়ে বলল, নানার অসুখ, দেখতে গিয়েছিলাম। আজই ফিরেছি। তারপর বলল, আসমার চিঠিতে জানতে পেরেছিলাম, আপনি হাঁটা চলা করতে পারছেন; এখন কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে ভালো। তোমরা সবাই ভালো আছ?
জ্বি ভালো। তারপর বলল, আসমাকে দেখছি না কেন?
মতি এই কদিন আসেনি কেন জানার জন্য আসমা আজ সকালে জাহিদকে তাদের বাড়ি পাঠিয়েছিল। জাহিদ ফিরে এসে জানিয়েছে, সে নানার বাড়ি গেছে। দুপুরে রান্নার কাজে মাকে সাহায্য করছিল। মতির গলার শব্দ পেয়ে তার বুক ধক ধক করতে লাগল। রান্না ঘর থেকে আব্বার ও মতির কথা শুনতে পাচ্ছে।
মোসারেফ হোসেন অনেক আগে থেকে ভেবে রেখেছিলেন, আসমাকে মতির হাতেই দেবেন। মতির বাবা যে দাবি-দাওয়া করবেন, তা দিতে পারবেন না ভেবে সে কথা কাউকে বলেননি। মতির বাবা মারা যাওয়ার পর মতিকে বলবেন বলবেন করেও বলেন নি। তারপর ঢাকায় গিয়ে রিয়াজুলের মতামত ও তার খালা-খালুর প্রস্তাব পাওয়ার পর ভেবেছেন, এই জন্য বোধহয়, আল্লাহ কথাটা মতিকে এতদিন বলতে দেননি। ভাবলেন, মতিকে এখনই রিয়াজুল ও আসমার বিয়ের কথা জানান দরকার। তিনি আসমাকে রান্নাঘরে যেতে দেখেছেন। মতি তার কথা জিজ্ঞেস করতে বললেন, আসমা রান্না ঘরে। তারপর তার নাম ধরে ডেকে বললেন, মতি এসেছে এক কাপ চা করে নিয়ে।
মতি বলল, না চাচা, এখন চা খাব না।
তা হলে সরবত খাও। তারপর মেয়েকে এক গ্লাস সরবত করে আনতে বলে বললেন, জান বাবা, রিয়াজুলের মতো ছেলে সারা দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তুমি বোধহয় জান, ওর খালা-খালু ওকে নিজের ছেলের মতো লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন। তারাও খুব ভালো মানুষ। আমার জন্য যা করেছেন, তা কেউ আপনজনের জন্যও করে না। তাদের কোনো সন্তানাদি নেই। রিয়াজুলই তাদের সব। তারা আসমাকে পছন্দ করে বৌ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তুমিই বল না বাবা, যারা আমার জন্য এত কিছু করলেন, তাদের প্রস্তাব কী ফিরিয়ে দিতে পারি? তারা কিছুদিনের মধ্যে এসে রিয়াজুলের ছোট চাচার বাড়িতে উঠবেন। তারপর বিয়ের ব্যবস্থা করবেন।
কথাটা শুনে মতির নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। তার সন্দেহ সত্যে পরিণত হতে যাচ্ছে জেনে রিয়াজুলের উপর প্রচণ্ড আক্রোশ হল। সেই সাথে আসমার উপরও কম হল না। মাথা নিচু করে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। তখন তার মনের মধ্যে প্রতিহিংসার ঝড় বইছে।
আসমা সরবত করার সময় আব্বার সব কথা শুনেছে। দুরু দুরু বুকে সরবতের গ্লাস। নিয়ে মতির সামনে এসে বলল, মতি ভাই সরবত নাও।
আসমার হাতের কোনো কিছু খেতে মতির ইচ্ছা হল না। যে আসমাকে দেখার জন্য আজ একমাস অধীর আগ্রহ নিয়ে দিন গুনেছে, যার আসার খবর পেয়ে ছুটে এসেছে, সেই আসমার দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করল না। মাথা নিচু করে বসেই রইল।
অনুরোধ করার শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও আসমা করতে পারল না।
মতি এলে সবসময় আসমাকে আগে বেড়ে তার সঙ্গে কথা বলতে মোসারেফ হোসেন দেখেছেন। আসমার উপর সংসারের দায়-দায়িত্ব। তাই সে মতিকে দিয়ে অনেক কাজ করায়। সে জন্যে তারা অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলে। মেয়েকে মতির হাতে দেবেন ভেবে তাদের মেলামেশায় বাধা দেননি। বিয়ের কথা শোনার পর থেকে মেয়ের মুখ গম্ভীর দেখেছেন। আজ আবার আসমার বিয়ের কথা শুনে মতির অবস্থা দেখে মোসারেফ হোসেন। মনে মনে চমকে উঠলেন। ভাবলেন, তা হলে কী এদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সামলে নিয়ে বললেন, কী হল বাবা মতি, সরবতটা খেয়ে নাও।
না খেলে চাচা মনে কষ্ট পাবে ভেবে আসমার দিকে না তাকিয়ে সরবতের গ্লাস নিয়ে। খেল। তারপর গ্লাসটা পাশে রেখে এখন আসি চাচা বলে সালাম দিয়ে হন হন করে চলে গেল।