সে তো অনেক টাকার ব্যাপার। মহিম ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে আল্লাহ চাহে তো আগের থেকে ভালো আছি। কাল থেকে নিজে উঠে বসতে পারছি।
উনি বললেন, ঢাকায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করালে আরো তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবেন। আল্লাহ রাজি থাকলে কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। আর টাকা পয়সার কথা যে বললেন, সে চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। আল্লাহকে জানান, তিনিই ব্যবস্থা করে দেবেন।
কিন্তু বাবা বাড়িতে কোনো পুরুষ লোক থাকবে না, তোমার চাচি দুটো সেয়ানা মেয়ে নিয়ে একা থাকবে কি করে?
আপনার সেবা যত্নের জন্য আসমাও যাবে। মনোয়ার হোসেন চাচাকে রাত্রে এবাড়িতে থাকতে বলে যাবো। আর দিনের বেলা মতিকে বললে, সেও নিশ্চয় লক্ষ্য রাখবে। তারপর মতির দিকে তাকিয়ে বলল, কী মতি রাখবে না?
কিছুক্ষণ আগে আসমার মুখে রিয়াজুলের সাহায্য করার কথা শুনে মতির মনে যে সন্দেহের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিল, এখন আসমার ঢাকা যাওয়ার কথা শুনে সেই আগুন আরো বেশি জ্বলে উঠল। কিছু না বলে মাথা নিচু করে বসে রইল।
আসার সময় মতিকে দেখে রিয়াজুল বুঝতে পেরেছিল তার মন খারাপ। এখন তার মুখ দেখে ও তাকে মাথা নিচু করে চুপ করে থাকতে দেখে বুঝতে পারল, নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। নচেৎ যে মতির মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকে, তার এই অবস্থা কেন? বলল, মতি আমার মনে হচ্ছে কোনো কারণে তোমার মন খারাপ। তা পরে শুনব, এখন বল, চাচাকে ঢাকা নিয়ে গেলে তুমি কী এ বাড়ির দিকে লক্ষ্য রাখবে না? জেনেছি আত্মীয়দের মধ্যে একমাত্র তুমিই চাচাকে সবসময় সাহায্য কর।
মতি মাথা নিচু করেই বলল, হ্যাঁ করব।
আমি জানতাম, তুমি না করবে না। তারপর মোসারেফ হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল, সম্পত্তি মাফ জোক হয়ে ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেছে। আমি দু’একদিনের মধ্যে মিউট্রেসান করার জন্য দরখাস্ত করব। সামনের সপ্তাহে আমরা ঢাকা রওয়ানা দেব। তারপর বেশ কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বলল, এর মধ্যে একমাসের মতো সংসারের প্রয়োজনীয় হাট-বাজার করার মতো টাকা আছে। মতি বা মনোয়ার হোসেন চাচাকে দিয়ে করিয়ে নেবেন। মহিম ডাক্তারের কথা মতো ইনশাআল্লাহ আমরা এক মাসের আগেই ফিরব।
আসমা বলল, আপনি বলেছিলেন, পুকুরে মাছ চাষ করবেন। এখনই কিন্তু ডিম ছাড়ার সময়।
জেলে পাড়ায় গিয়ে সে ব্যবস্থা করেই এখানে এলাম। মদন জেলেকে পরশু ভোরে আসতে বলেছি। পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরে সব বিক্রি করে দেব। তারপর সার দেব। আর মদনকে বলেছি তিন চার দিনের মধ্যে মাছের ডিম ছাড়ার ব্যবস্থা করতে, তাতে যদি ঢাকা যেতে দু’একদিন দেরি হয় হবে।
মোসারেফ হোসেন চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না। গাল বেয়ে টপ টপ করে পড়তে লাগল।
তাই দেখে রিয়াজুল এগিয়ে এসে তার একটা হাত ধরে বলল, চাচা আপনি কাঁদছেন কেন? অসুস্থ বোধ করছেন?
চোখ মুছে মোসারেফ হোসেন ভিজে গলায় বললেন, না বাবা, তা নয়। আল্লাহর মহিমা চিন্তা করে সামলাতে পারছি না। এত সুখ, এত আনন্দ জীবনে কোনোদিন পাইনি। তারপর ফুঁপিয়ে উঠে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, এই গোনাহগার বান্দার দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন কিনা জানি না, তবু করছি, আল্লাহ তোমার ইহজীবন ও পরজীবন সুখের করুন, শান্তির করুন, তোমাকে হায়াতে তৈয়েবা দান করুন, তোমার হায়াত দারাজ করুন।
রিয়াজুল তার পায়ে হাত ছুঁয়ে চুমো খেয়ে বলল, আপনি আমার বাবার মতো। আর আল্লাহ সন্তানের প্রতি মা-বাবার দোয়া কবুল করেন। এটা হাদিসের কথা। আপনার কাছ থেকে শুধু আমি দোয়াই কামনা করি। তারপর সালাম বিনিময় করে মতিকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
রাস্তায় এসে মতি বলল, রিয়াজুল ভাই, আপনি যান, আমি একটু শেখ পাড়ায় যাব।
রিয়াজুল বলল, ঠিক আছে যাও। আমি পরে তোমার সঙ্গে দেখা করব। তারপর পোষ্ট অফিসে গিয়ে মা-বাবাকে সব কিছু জানিয়ে একটা চিঠি লিখে পোষ্ট করে দিয়ে ফিরে এল।
মতি যেতে যেতে চিন্তা করল, রিয়াজুল ভাইয়ের কাছে আমি কিছুই না। সে যেভাবে আসমাদের সাহায্য করছে, আমার দ্বারা তা সম্ভব নয়। আসমা এখন কি আর আমাকে বিয়ে করতে চাইবে? তারপর আবার চিন্তা করল, রিয়াজুল কী বাবার বন্ধুকে শুধু শুধু সাহায্য করছে, নাকি আসমাকে পাওয়ার জন্য করছে? যদি আসমাকে পাওয়ার জন্য করে, তা হলে আমিও দেখব, কি করে পায়। আর আসমা যদি বেঈমানি করে, তা হলে তাকেও দেখে নেব।
জালাল শেখ মতির বন্ধু। একসঙ্গে এস.এস.সি. পাশ করেছে। জালাল এস.এস.সি. পাশ করে ঢাকায় চাকরির চেষ্টায় গিয়ে সন্ত্রাসীদের পাল্লায় পড়ে চাঁদাবাজি ও হাইজ্যাক করে বেড়াত। কয়েকবার ধরা পড়ে জেলও খেটেছে। বছরখানেক হল বিয়ে করে গ্রামেই আছে। শ্বশুরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে আড়তের ব্যবসার করছে। গ্রাম থেকে বিভিন্ন তরিতরকারী ও ধান-চাল কিনে ঢাকার আড়তদারদের সাপ্লাই দেয়। সে যে ঢাকায় সন্ত্রাসী করত, তা গ্রামের কেউ না জানলেও মতি জানত। তাই জালাল যখন মাঝে মাঝে বাড়ি আসত তখন মতি তাকে ভালো হওয়ার পরামর্শ দিত। ব্যবসা শুরু করার পর মতির সঙ্গে আগের বন্ধুত্ব আরো গম্ভীর হয়েছে! মতি যে আসমাকে ভালোবাসে ও তাকে বিয়ে করতে চায়, সে কথা জালালকে বলেছিল। আজ যখন মতি বুঝতে পারল, রিয়াজুলের জন্য আসমাকে পাওয়া যাবে না তখন জালালের কাছে পরামর্শ করার জন্য গেল।