মতি আর ঢাকায় চাকরি করতে গেল না। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব এখন তার ঘাড়ে।
একদিন মতি আমাদের পুকুরের খদ্দের ঠিক করে মোসারেফ হোসেনের সঙ্গে দেখা করে ফেরার সময় আসমাকে কথাটা জানাল।
আসমা বলল, পুকুর বিলি করব না। রিয়াজুল ভাই নিষেধ করেছেন।
জমি রেকর্ড করার ব্যাপারে রিয়াজুলের নাম গ্রামময় ছড়িয়ে পড়েছে। সে যে উচ্চ শিক্ষিত ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত, তা গ্রামের সবাই জেনে গেছে। সে জন্যে তারা তাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তার সঙ্গে মতির বেশ জানাশোনা হলেও এদের সংসারের কর্তৃত্ব করছে তা জানে না। তাই বেশ অবাক হয়ে বলল, রিয়াজুল ভাই নিষেধ করেছেন, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আসমা বলল, সেদিন বললাম না, আব্বার সঙ্গে ওঁর আব্বার বন্ধুত্ব ছিল। সে কথা জেনে উনি আব্বাকে খুব সম্মান করেন। প্রায় আব্বাকে দেখতে আসেন। আব্বার চিকিৎসাও করাচ্ছেন। যেদিন পুকুর বিলির কথা তোমার সাথে আলাপ করলাম, সেদিন তুমি চলে যাওয়ার পর আমার কাছে থেকে পুকুর বিলির কথা শুনে নিষেধ করে বললেন, উনি পুকুরে মাঝের চাষ করার ব্যবস্থা করে দেবেন। আমাদের সংসারের সব দায়িত্ব এখন ওঁর উপর। জান মতি ভাই, উনি খুব ভালো ছেলে। আজকালের যুগে নিজের ছেলেই মা-বাবাকে দেখে না। বন্ধুর ছেলে হয়ে আব্বার জন্য যা করছেন, তা কেউ বিশ্বাস করবে না।
মতির মনে সন্দেহ হল, ভাবল, এতকিছু করার পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। আসমাকেও দেখছি তার কথা খুব আনন্দের সঙ্গে বলছে। তা হলে কী আসমার মন জয় করার জন্য এতকিছু করছে? আসমাকে কী আমি পাব না? সেও কী রিয়াজুলের টাকা দেখে তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে?
তাকে চুপ করে ভাবতে দেখে আসমা বলল, কী হল মতি ভাই, রিয়াজুল ভাইয়ের কথা শুনে কী এত ভাবছ?
আমার কথা শুনে মতির মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ম্লান মুখে বলল, টাকাওয়ালা রিয়াজুল ভাইকে যখন পেয়েছ, তখন আর আমাকে তোমাদের দরকার নেই, কি বল?
আসমা বুঝতে পারল, মতি ভাই রিয়াজুল ভাইকে হিংসা করছে। বলল, মতি ভাই, তুমি ব্যাপারটা অন্যভাবে নিচ্ছ কেন? রিয়াজুল ভাই আব্বাকে নিজের বাবার মতো মনে করে। আব্বা তাকে পেয়ে ভাইয়ার কথা ভুলে গেছে। আমরাও তাকে বড় ভাইয়ের মতো মনে করি। এতে তুমি মনে কিছু করছ কেন? তিনি খুব উদার মনের ছেলে। তার সঙ্গে পরিচয় করো, তা হলে আমার কথা সত্য না মিথ্যা জানতে পারবে।
তাই জানব বলে মতি ভারাক্রান্ত মনে ফিরে আসার সময় রিয়াজুলকে আসতে দেখে অন্য পথ ধরল।
রিয়াজুল তাকে দেখতে পেয়ে ডাকল, মতি শোন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
মতি তার প্রতি অসন্তুষ্ট হলেও ডাক শুনে একরকম বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রিয়াজুল কাছে এসে সালাম দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার? তোমার মনটা খারাপ দেখছি?
মতি সালামের উত্তর দিয়ে জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কই না তো।
আমি তোমাদের বাড়ি গিয়ে না পেয়ে ফিরে এলাম। কোথাও যাচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ, তা আমার কাছে গিয়েছিলেন কেন?
তোমার সঙ্গে একটু আলাপ আছে। চল মোসারেফ চাচাদের ঘরে। আলাপটা ওঁর কাছেই করব। কয়েকদিন কাজের চাপে দেখতে যেতে পারিনি।
আমি একটু আগে গিয়েছিলাম। আপনি যান, পরে না হয় আলাপ করবেন।
গেছ তো কি হয়েছে? আলাপটা চাচার ব্যাপারেই তাই তো বললাম, ওঁর কাছেই করব।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মতি বলল, চলুন তা হলে।
যেতে যেতে রিয়াজুল বলল, চাকরি করতে তা হলে আর ঢাকায় যাবে না?
চাকরি করতে গেলে সংসার দেখবে কে?
হাঁ, তোমার কথাই ঠিক। সংসার ও ভাই-বোনদের লেখাপড়া করানোর দায়িত্ব তো তোমাকেই বইতে হবে। তুমি মন খারাপ করো না। মানুষের চিরকাল দুঃখ থাকে না। আল্লাহর উপর ভরসা করে কর্তব্য করে যাও। তিনি বড়ই মেহেরবান। একদিন না একদিন তোমাদের দুঃখের অবসান ঘটাবেন।
মতি চলে যাওয়ার পর আসমা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে তার কথা চিন্তা করছিল, মতি ভাই তা হলে রিয়াজুল ভাইকে ভুল বুঝেছে। ভুলটা তার ভাঙ্গতে হবে। কি করে ভাঙ্গাবে সেই কথা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ দেখতে পেল, রিয়াজুল ভাইয়ের সঙ্গে মতি ভাইও আসছে। কাছে এলে সেই আগে সালাম দিল।
রিয়াজুল সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করল, চাচা কেমন আছেন?
আসমা বলল, আগের থেকে একটু ভালো। নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার ফলে কাল থেকে নিজেই উঠে বসতে পারছেন।
শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে রিয়াজুল বলল, চল ওঁর কাছে যাই।
মাহমুদা বিবি মুরগী হাঁসকে কুড়ো খাওয়াচ্ছিলেন। তাদেরকে দেখে ঘোমটা টেনে আড়াল হয়ে গেলেন!
ঘরে ঢুকে রিয়াজুল সালাম দিল।
মোসারেফ হোসেন খাটে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। সালামের উত্তর দিয়ে তাদেরকে বসতে বললেন।
বসার পর রিয়াজুল বলল, জমির রেকর্ড ও ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কয়েকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। তাই আসতে পারিনি। কিছু মনে করেননি তো?
ছেলের কথা শোন, মনে করব কেন? মনোয়ারের মুখে শুনলাম, তুমি যা করেছ, তা কেউ কখনো করেনি। তোমার সাহস দেখে গ্রামের লোকজন যেমন অবাক হয়েছে তেমনি। বাহবাও দিয়েছে।
ওসব কথা থাক চাচা, যে জন্য এসেছি তা বলছি শুনুন। আমি মহিম ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করেছি। উনি বললেন, আপনাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে একজন বড় ডাক্তারকে দেখাতে। তাই কয়েকদিনের মধ্যে আপনাকে ঢাকা নিয়ে যাব।