হাকিম সাহেব সবাইকে থামতে বলে রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি?
রিয়াজুল বলল, আমি নূরুদ্দিন ও সামসুদ্দিন মিয়ার মেজ ভাই মরহুম সালাউদ্দিন মিয়ার ছেলে। আমি আমার মায়ের পেটে থাকতে উনি মারা গেছেন। তারপর রফিককে দেখিয়ে বলল, এ আমার ফুফাতো ভাই। আমার ফুফু বেঁচে আছেন। তিনিও অংশীদার। তার নাম তানজিলা বেগম।
হাকিম সাহেব নাম লিখে নিয়ে নূরুদ্দিন মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কী বড় মিয়া, আপনি জ্ঞানী-গুনী, তার উপর মাতবর মানুষ হয়ে এরকম কাজ করতে পারলেন?
রিয়াজুল যে তাকে এতবড় অপমান করবে নূরুদ্দিন মিয়া কল্পনাও করেননি। রাগে ও লজ্জায় মাথা নিচু করে ঘরে ফিরে এসে ছেলেদের ডেকে ঘটনাটা বলে বললেন, ওকে আমি বন্দুক দিয়ে গুলি করে শেষ করে দেব। ও আমার মান ইজ্জত ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ব্যাটা ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ দেখেনি। ফাঁদে ফেলে ব্যাটাকে কি করি বুঝবে।
রিয়াজুল ছোট চাচার কাছ থেকে সমস্ত সম্পত্তির দাগ ও খতিয়ান নাম্বার নিয়ে সবগুলোতে তার মরহুম বাবার ও ফুফুর নাম রেকর্ড করাবার জন্য একটা দরখাস্ত লিখে এনেছিল। সেটা হাকিম সাহেবের কাছে জমা দিল।
সেখানে চেয়ারম্যান আলি আসগর ছিলেন। রিয়াজুলকে বাইরে ডেকে নিয়ে এসে বললেন, তোমার বড় চাচা তোক ভালো নয়, এটা গ্রামের সবাই জানে। তবু এভাবে অপমান করা তোমার ঠিক হয়নি।
রিয়াজুল বলল, চেয়ারম্যান চাচা, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমিও এটা করতে চাইনি। তাই ওঁকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই রাজি হননি। একরকম বাধ্য হয়েই এই কাজ করতে হল।
কিন্তু বাবাজি ওঁর সঙ্গে বিবাদ করে তুমি গ্রামে থাকতে পারবে?
থাকতে পারব কিনা সে কথা আল্লাহপাক জানেন। আমি আল্লাহপাককে ছাড়া কাউকে ভয় করি না। হায়াত মউত আল্লাহপাকের হাতে। সত্যের জন্যে যদি প্রাণ দিতে হয়, তাতেও আমার কোনো দুঃখ নেই। আমার মা-বাবা নেই যে, আমি মারা গেলে দুঃখ পাবেন। আপনি দোয়া করবেন চাচা, আমি যেন সত্যের জন্য সংগ্রাম করতে পারি। তারপর সালাম বিনিময় করে রফিককে নিয়ে সেখান থেকে চলে এল।
নূরুদ্দিন মিয়া লজ্জায় প্রায় এক সপ্তাহ ঘরের বাইরে বের হলেন না। তিন ছেলেকে নিয়ে পরামর্শ করলেন, রিয়াজুলকে এমনভাবে খুন করবেন, যেন কেউ তাদেরকে সন্দেহ করতে না পারে। মেজ ও ছোট কিছু না বলে চুপ করে থাকল। বড় আলাউদ্দিন বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, যা করার আমি করব।
নূরুদ্দিন মিয়া অন্য দুজন ছেলেকে বললেন, তোমরা কিছু বলছ না কেন?
মেজ ছেলে কলিমউদ্দিন বলল, আমার মতে খুন করলে পুলিশরা যেমন করে থোক খুনিকে বার করে ফেলবে। তার চেয়ে সে যাতে এখানে থাকতে না পেরে ঢাকা ফিরে যায় সেই ব্যবস্থা করাই ভালো।
মেজ ভাই থেমে যেতে ছোট রিয়াজ উদ্দিন বলল, আপনি এতদিন অনেক অন্যায় করেছেন। বাবা হিসাবে সম্মান করে কিছু বলিনি। কিন্তু আর না বলে পারছি না। আপনি যা করতে চাচ্ছেন, তা অন্যায় ও পাপ। এসব পথ আপনার পরিত্যাগ করা উচিত।
নূরদ্দিন মিয়া রেগে উঠে বললেন, তুমি আমাকে উপদেশ দিচ্ছ? আমার অন্যায়টা দেখেতে পেলে, আর রিয়াজুল যে আমাকে সাত গ্রামের মানুষের কাছে অপমান করল, সেটা বুঝি কিছু নয়?
আপনি নিজের ভুলের কারণে অপমানিত হয়েছেন। সম্পত্তিতে তার বাবার নাম রেকর্ড করিয়ে আপনি কী ভুল করেননি? সে তো আপনার কাছে পরামর্শ করতে এসেছিল। আপনি তাকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন। তাই হাকিমের কাছে প্রতিবাদ করেছে।
চুপ কর বেয়াদব কোথাকার। শত্রুর হয়ে কথা বলতে তোর লজ্জা করছে না। লেখাপড়া করে তুমি জানোয়ার হয়েছ। যে ছেলে বাবার মান সম্মানের চেয়ে শত্রুর পক্ষে কথা বলে, তার মুখ আমি দেখতে চাই না। দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে।
রিয়াজউদ্দিন আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেল।
একটু পরে কলিমউদ্দিন ছোট ভাইকে অনুসরণ করল।
আলাউদ্দিন বলল, দেখলেন আব্বা, ওরা কেমন পাশ কেটে চলে গেল।
নূরুদ্দিন মিয়া বললেন, ওদের কথা বাদ দাও। তুমি তোমার মতো করে কাজ কর।
৭-৮. মতি যেদিন ঢাকা যাবে
মতি যেদিন ঢাকা যাবে তার আগের দিন রাত্রে হঠাৎ বুকে ব্যাথা উঠে তার বাবা মারা গেলেন। ব্যাথা উঠতে মতি ডাক্তার এনেছিল। উনি বললেন, হার্ট এটাক করেছে। হাসপাতালে নিতে হবে। অত রাত্রে হাসপাতালে কিভাবে নিয়ে যাবে কোনো উপায় না পেয়ে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর মারা যান। পরের দিন সকালে দাফন কাফনের ব্যবস্থা হল। খবর পেয়ে গ্রামের লোকজন এসেছিল। মতির কান্না দেখে রিয়াজুল তাকে অনেক সান্তনা দিল।
বিকেলে মতি আসমাদের ঘরে এসে মোসারেফ হোসেনের কাছে অনেক কান্নাকাটি করল।
মোসারেফ হোসেন তাকে খুব স্নেহ করেন। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, সবর কর বাবা সবর কর। কার কখন হায়াত শেষ হবে, তা কেউ জানে না। তুমি তোমার বাবার বড় ছেলে। তুমি ভেঙ্গে পড়লে ছোটদের সান্তনা দেবে কে? তাদেরকে তুমিই তো এখন মানুষ করবে। এই আমাকেই দেখ না, বেঁচে থেকেও না থাকার মতো। বড় ছেলেটাকে আল্লাহ তুলে নিল। আমি বুকে পাথর বেঁধে সবর করে আছি। নিজেরও এই অবস্থা, ঘরে দু’টো সেয়ানা মেয়ে। কি যে হবে আল্লাহকেই মালুম। তারপর নানারকম কথা বলে প্রবোধ দিয়ে বিদায় দিলেন।