তা উচিত, তবে আমার মনে হয় তোমার আরো কোনো মতলব আছে।
এরকম মনে হওয়ার কী কোনো কারণ ঘটেছে?
না, তা ঘটেনি। নিকট আত্মীয় তো কত রয়েছে। তারা কখনো দু’চার টাকা দিয়ে। সাহায্য করেনি। তুমি দূর সম্পর্কের হয়ে করছ, তাই বললাম আরকি।
মতি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, তুমি কি অনুমান করেছ জানি না, তবে যদি রেগে যাবে না বলে কথা দাও, তা হলে বলতে পারি।
তার হাবভাব দেখে আসমা অনেক আগেই বুঝেছে, সে তাকে ভালবাসে। ভাবল, সেই কথাই হয়তো বলবে। অনুমানটা যাচাই করার জন্য বলল, রাগব না, কি বলবে বল।
তুমি যখন ঘুঁসি মেরে দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছিলে, তার অনেক আগে থেকেই তোমাকে ভালবাসি। তাই তো সেদিন ভালো হতে বলেছিলাম।
আসমার অনুমানই ঠিক হল। তবু ভালবাসার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। কারণ সেও মতিকে ভালবেসে ফেলেছে।
মতি বলল, খুব রেগে গেছ মনে হচ্ছে। এক্ষুণি কিন্তু রাগবে না বলেছ।
আসমা মাথা নিচু করেই বলল, না, রাগিনি মতি ভাই। তবে…. বলে থেমে গেল।
তবে কী বলবে তো?
আসমা কিছু বলল না।
তবে কী আমাকে তুমি পছন্দ কর না?
না তাও না। পরে একদিন বলব।
ঠিক আছে, আজ আসি বলে মতি চলে গেল।
.
মতির এক মামা ঢাকা জজ কোর্টে মুহুরীর কাজ করেন। তার তদবীর এক উকিলের চেম্বারে মতি পিয়নের চাকরি পেল। উকিলের বাসায় থাকা-খাওয়া, বেতন এক হাজার টাকা;
মতি ঢাকায় চাকরি করতে যাওয়ার আগের দিন মোসারেফ চাচাদের বাড়িতে সে কথা জানিয়ে ফেরার সময় আসমাকে ইশারা করে বাইরে আসতে বলল।
আসমা তার সাথে পুকুর পাড়ে এসে বলল, ঢাকায় গেলে মানুষ গ্রামের সবকিছু ভুলে যায়।
মতি বলল, সবাই একরকম হয় না। ওসব কথা থাক, তোমাকে আজ আমার দু’আড়াই বছর আগের সেই একটি প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। নচেৎ ভাববো, সত্যি সত্যি তুমি আমাকে পছন্দ কর না।
আসমা বলল, এতদিনেও কী তুমি বুঝতে পারনি? শুধু মুখে বললেই কী হয়? ছেলেরা মুখ ফুটে যা বলতে পারে মেয়েরা তা পারে না। তুমি চাকরি করতে ঢাকায় চলে যাবে শোনার পর থেকে খুব খারাপ লাগছে। আমার মুখ দেখেও তুমি বুঝতে পারছ না?
মতির মন আনন্দে নেচে উঠল। এদিক ওদিক তাকিয়ে খপ করে তার দুটো হাত ধরে চুমো খেয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, আজ এতদিন পরে আল্লাহ তোমার মনের কথা জানালেন, সেই জন্যে তাঁর পাক দরবারে শত কোটি শুকরিয়া জানাই। তারপর বলল, নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে।
আসলেও তুমি তাই। তা না হলে এক নিঃস্ব বাবার মেয়েকে ভালবাসতে না।
এ আবার কি কথা বলছ, আমি তো বুঝতে পারছি না?
বোকা না হলে ঠিকই বুঝতে পারতে। তোমার বাবা কী তার ছেলের বিয়ে যৌতুক ছাড়া দেবেন? তার উপর তুমি আবার চাকরি পেয়েছ।
তা হয়তো দেবেন না, তবে আমার অমতেও কিছু করতে পারবেন না। যা জানার আমার জানা হয়ে গেছে। যৌতুকের ব্যাপারটা আমি বুঝব। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
মতি ভাই, একটা কথা বলব কিছু মনে করবে না বল?
তোমার কোনো কথাতেই আমি কিছু মনে করব না। তুমি নিশ্চিন্তে বল।
তুমি আমাকে ভুলে যাও। কারণ যৌতুকের কথা বাদ দিলেও আব্বাকে এই অবস্থায় ফেলে বিয়ে করা কিছুতেই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি চলে গেলে সংসারের অবস্থা কি হবে ভেবে দেখ।
মতি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কি হবে আল্লাহকে মালুম। তবে এটা শুনে রাখ, তোমার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করব। অনেকক্ষণ এসেছি, এবার আসি। ছুটিতে যখন আসব তখন এ ব্যাপারে আলাপ করব।
.
০২.
মোসারেফ হোসেন আজ তিন বছরের বেশি পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। আড়াই বিঘা জমি বেচে বড় ছেলে ইলিয়াসকে কুয়েত পাঠিয়েছিলেন। আরো আড়াই বিঘা বেচে নিজের চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু বাক শক্তি ফিরে পাওয়া ছাড়া আর কোনো উন্নতি হয়নি।
ভাইয়া ও আব্বার দুর্ঘটনার পর আসমার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার আসমা যেন আগের আসমা নয়। প্রথম কয়েকদিন তো চুপচাপ পুকুর পাড়ে নির্জন কোনো গাছতলায় বসে বসে কাঁদত। ছোট বোন সালেহা তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাওয়াত। মোসারেফ হোসেন মেয়েকে অনেক বুঝান। একদিন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, মা, আল্লাহ তোর ভাইকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলেন। আমাকেও পঙ্গু করে দিলেন। তুইও যদি ভেঙ্গে পড়িস, তা হলে সালেহাকে, জাহিদকে কে দেখবে? তুই বড় হয়েছিস, লেখাপড়াও করেছিস, এত ভেঙ্গে পড়লে চলবে? তোর মাকে তো জানিস, সে মাটির মানুষ। তোকেই তো এখন সংসারের সব দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।
তারপর থেকে আসমার পরিবর্তন এল। নিয়মিত নামায ও কোরআন পড়তে লাগল। এখন আর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় না। কোনো কারণে কোথাও গেলে গায়ে মাথায় চাদর জড়িয়ে যায়। মুরুব্বিদের সঙ্গে দেখা হলে রাস্তা ছেড়ে একপাশে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। যেসব ছেলে-মেয়েরা তাকে দেখলে ছুটে পালাত, এখন তাদেরকে আদর করে বুকে টেনে নেয়। এসব দেখে গ্রামের লোকজন বলাবলি করে, ভাই মারা যাওয়ার পর ও বাপ পঙ্গু হয়ে যেতে মোসারেফ হোসেনের মেয়েটা খুব ভালো হয়ে গেছে। গ্রামের বৌড়ী-ঝিউড়ীরা স্বস্তি পেয়ে নির্ভয়ে তাদের পুকুর থেকে কলসি করে পানি নিয়ে যায়।
ছোট মেয়ে সালেহার ক্লাস নাইনে উঠার পর পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। টাকার জন্য মোসারেফ হোসেনের চিকিৎসাও বন্ধ হয়ে গেছে। স্ত্রী হামিদা বিবি খুব পর্দানশীন ও ধার্মীক মহিলা। তিনি সব ছেলে মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে সেই মতো মানুষ করলেও বড় মেয়ে আসমা ছোট বেলা থেকে বড় দুষ্টু। তাকে বাগে আনতে পারেননি। এখন তার পরিবর্তন দেখে খুব খুশি হয়ে আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করেন। আসমা আব্বার যে সমস্ত ধর্মীয় বই পুস্তক ছিল, সেই সব পড়ে নিজে যেমন মেনে চলে, তেমনি ছোট দুটো ভাই-বোনকেও শিক্ষা দেয়। এখন সে বিশ বছরের যুবতী। সংসারের দায়-দ্বায়িত্ব তার উপর। সকালে ও বিকালে স্কুলের কয়েকটা ছেলে মেয়েকে পড়ায়। ছোট ভাই জাহিদ পড়া শোনায় খুব ভালো। তাই শত অভাবের মধ্যেও তার পড়া বন্ধ করেনি। সে এখন ক্লাশ সিক্সে পড়ে।