নূরুদ্দিন মিয়া খুব রেগে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, কার কাছে শুনেছ?
মাফ করবেন, বলতে পারব না। কথাটা সত্য কিনা জানতে চাই।
নূরুদ্দিন মিয়া প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছেন, সামসুদ্দিন এদের পিছনে আছে। আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার বাবার সম্পত্তি তুমি পাবে, আর তানজিলাও তার সম্পত্তি পাবে। রেকর্ড নিয়ে তোমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে।
শুধু সম্পত্তি পেলে তো হবে না, রেকর্ড থাকতে হবে। নচেৎ ভবিষ্যতে বংশধরদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হবে।
তুমি ছেলে মানুষ। বিষয় সম্পত্তির জটিলতা বুঝবে না। ভবিষ্যতের যে বিবাদের কথা বললে, সব সম্পত্তিতে সবাইয়ের নাম লেখালে ভবিষ্যতে সেই বিবাদ আরো বেশি হবে। আমি আর এ ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাই না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, তোমরা তোমাদের অংশ মতো সম্পত্তি পেয়ে যাবে।
বেয়াদবি নেবেন না, আমি ও ফুফু কিন্তু রেকর্ডে নাম লেখাতে চাই।
নূরুদ্দিন মিয়া রাগে ফেটে পড়লেন, ও…. তা হলে তোমরা ফুফু ভাতিজাতে যুক্তি করে এসেছ?
আপনি যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন, আমরা কিন্তু নাম রেকর্ড করাবই।
নূরুদ্দিন মিয়া তানজিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুইও কী তাই চাস?
তুমি রেগে যাচ্ছ কেন বড় ভাই? রিয়াজুল তো উচিত কথা বলেছে।
ঠিক আছে পারলে লেখাস। তারপর সেখান থেকে চলে গেলেন।
রিয়াজুল ও তানজিলা সামসুদ্দিনের বাড়ি ফিরে এল।
এশার নামাযের পর নূরুদ্দিন মিয়া তিন ছেলেকে ডেকে সব কথা বলে বললেন, পঁচিশ বছর পর সালাউদ্দিনের ছেলে এসে যে ঝামেলা বাধাবে, তা কখনো ভাবিনি। এখন তোমরা কি সিদ্ধান্ত নেবে বল।
বড় ছেলে আলাউদ্দিন বাবার মতো হয়েছে। সে বলল, ঝামেলা বাধাবার আগে রিয়াজুলকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়। আর ফুফুকে কিছু দিয়ে সন্তুষ্ট করে দিলেই হবে।
নূরুদ্দিন মিয়া মেজ ও ছোট ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি বল?
মেজ কলিম উদ্দিন যেমন চালাক তেমনি কৃপণ। বলল, আমার মতে ফুফুর মতো রিয়াজুলকেও কিছু দিয়ে সন্তুষ্ট করাই ভালো। খুন-খারাবি করার পক্ষে আমি নেই। এসব ব্যাপার চাপা থাকে না। থানা পুলিশ হলে কেলেঙ্কারীর শেষ থাকবে না। তা ছাড়া টাকা পয়সাও কম খরচ হবে না। তারপর রিয়াজউদ্দিনের দিকে চেয়ে বলল, তুই কি বলিস?
আলাউদ্দিন ও কলিমউদ্দিন ক্লাশ টেন পর্যন্ত পড়লেও পরীক্ষা দেয়নি। রিয়াজউদ্দিন বি.এ. পাশ করে হাইস্কুলে মাষ্টারী করে। বড় ভাইদের কথা শুনে সন্তুষ্ট হতে পারল না। বলল, আমার মনে হয়, ছোট চাচার সঙ্গে পরামর্শ করে যার যা অংশ তা দিয়ে দিলে কোনো ঝামেলাই থাকবে না।
নূরুদ্দিন মিয়া তিন ছেলেকে কিছু কিছু সম্পত্তি দিয়ে আলাদা করে দিয়েছেন। বড় ও মেজ গৃহস্থালী করে। আর ছোট স্কুলে শিক্ষকতা করে ও টিউশনী করে মোটা টাকা রোজগার করে। এর মধ্যে বেশ কিছু জমি জায়গাও কিনেছে। বড় ও মেজ তাকে হিংসা করে।
আলাউদ্দিন তার কথা শুনে জ্বলে উঠে বলল, তুই তো এই কথা বলবি। তোর তো কোনো অভাব নেই। অংশ মতো সব কিছু দিলে আমরা আর কতটুকু পাব। এখনই সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। সম্পত্তি দিয়ে দিলে উপোস করে মরতে হবে।
কলিমউদ্দিন বলল, হ্যাঁ বড় ভাই, তুমি ঠিক কথা বলেছ। রিয়াজউদ্দিন আছে নবাবী হালে। আমাদের কষ্ট বুঝবে কি করে?
রিয়াজউদ্দিন রেগে উঠে বলল, তোমরা উল্টো পাল্টা কথা বলছ কেন? আমার মতামত জানতে চেয়েছিলে বললাম। পছন্দ না হলে তোমরা তোমাদের মতলব মতো কাজ করবে তাতে আমার কী? তবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমাকে জড়াবে না। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, ছোট চাচার সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছু সিদ্ধান্ত নেবেন না। কথা শেষ করে সেখান থেকে চলে গেল।
আলাউদ্দিন বলল, দেখলেন আব্বা, রিয়াজউদ্দিনের কত দেমাগ। আমাদেরকে বড় ভাই বলে গ্রাহ্য তো করলই না, এমন কি আপনাকেও করল না।
নূরুদ্দিন মিয়া রিয়াজউদ্দিনকে ছোট বেলা থেকেই স্বাধীনচেতা দেখে এসেছেন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অনেক সময় তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেও দেখেছেন। তখন রেগে গেলেও প্রতিবাদ করেননি। আজও তার কথায় রেগে গিয়েও করলেন না। আলাউদ্দিনের কথা শুনে বললেন, রিয়াজউদ্দিনের স্বভাব তো তোমরা জান। তার কথা বাদ দাও। সামসুদ্দিনের সঙ্গে আমি আগে কথা বলে দেখি, তারপর যা করার তোমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে করব। এখন তোমরা যাও।
নূরুদ্দিনের স্ত্রী সায়মা বিবি এতক্ষণ আড়াল থেকে সবকিছু শুনছিলেন। ছেলেরা চলে যাওয়ার পর স্বামীর কাছে এসে বললেন, অনেক রাত হয়েছে খাওয়া দাওয়া করবে না? প্রতিদিন তো এশার নামাযের পর খাও। আজ খিধে পায়নি?
নূরুদ্দিন হাই তুলে বললেন, রিয়াজুল ঝামেলা বাধিয়ে খিধে মেরে দিয়েছে।
তার বাবার অংশ তাকে দিয়ে দিলেই তো ঝামেলা মিটে যায়।
তুমি মেয়ে মানুষ, সংসারের ঝামেলা শুধু বোঝ, সম্পত্তির ঝামেলায় নাক গলিও না। চল খেতে দেবে।
রিয়াজুল ও তানজিলা ফিরে এলে সামসুদ্দিন মিয়া তাদের কাছ থেকে সব কিছু শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবতে লাগলেন।
রিয়াজুল বলল, চাচা কি এত ভাবছেন?
ভাবছি, বড় ভাই ডেকে পাঠালে কী বলব?
এতে ভাববার কি আছে? আপনি আপনার নিজস্ব মতামত বলবেন।