রাত্রে ঘুমাবার সময় জাহিদ বলল, বড় বুবু, তখন যাকে বড় ভাই বলে কদমবুসি করতে বললে, সে কে? কই তাকে তো আগে কখনও দেখিনি?
আসমা বলল, মিয়া বাড়ির যে ছেলেটা তোর সঙ্গে পড়ে উনি তার বাবার মেজ চাচার ছেলে। ওঁর মা-বাবা ওঁকে খুব ছোট রেখে মারা গেছেন। সেই থেকে ঢাকায় খালার কাছে ছিলেন। কয়েকদিন হল এসেছেন। ওঁর বাবার সঙ্গে আব্বার বন্ধুত্ব ছিল। এখানে এসে সে কথা জানতে পেরে আমাদেরকে আপন করে নিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে দেখা হলে সালাম দিবি। কোনো রকম বেয়াদবি করবি না : তারপর সালেহার উদ্দেশ্য করে বলল, তুইও তাই করবি। তোকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দিতে বলেছেন।
জাহিদ বলল, আমরা ওঁকে কি বলে ডাকব?
ভাইয়া বলে ডাকব।
উনি তোমাকে আমার লুঙ্গি কিনে দিতে বলেছেন?
হ্যাঁ বলেছেন। কাল মনোয়ার চাচাকে টাকা দেব, লুঙ্গি এনে দেবে।
.
০৬.
পরের দিন সকালে রিয়াজুল ফুফুকে নিয়ে বড় চাচাদের বাড়িতে গেল। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর নূরুদ্দিন মিয়া তানজিলার সঙ্গে তার স্বামীর বাড়ির খোঁজ নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতে লাগলেন।
একসময় রিয়াজুল বলল, বড় চাচা আমি কিছু আলাপ করতে চাই।
রিয়াজুল আসার পর থেকে নুরুদ্দিন মিয়া এরকমই আশা করেছিলেন। বললেন, বেশ তো কি আলাপ করতে চাও বল।
আমি আমার মরহুম আব্বার অংশের সম্পত্তি পেতে চাই।
বাবার সম্পত্তি নেবে, ভালো কথা। আমি সামসুদ্দিনের সঙ্গে আলাপ করে ব্যবস্থা করে দেব।
ছোট চাচার কাছে জানলাম, আব্বার সম্পত্তি আপনারা দু’ভাই নাকি ভাগ করে নিয়ে ভোগ দখল করছেন?
হ্যাঁ ঠিকই জেনেছ।
এত বছরের ফসলি জমির ফসল আপনারা নিশ্চয় বিক্রি করেছেন? সেই সব টাকা দেবেন না?
জমিতে ফসল তো আপনা-আপনি হয় না, প্রচুর খরচ করতে হয়।
তাতো হবেই। আপনারা খরচ করে চাষ করেছেন সেজন্যে ফসলের অর্ধেক পাবেন। বাকি অর্ধেক তো আমার পাওনা।
ঠিক আছে, এ ব্যাপারেও সামসুদ্দিনের সঙ্গে আলাপ করব।
এবার তানজিলা বলল, বড় ভাই, আমিও আমার অংশের সম্পত্তি পেতে চাই।
নূরুদ্দিন মিয়া রেগে উঠে বললেন, কেন? তোর আবার কিসের অভাব? আকবর হোসেন তোকে কি খোর-পোষ দিচ্ছে না?
হাজার দিলেও আমি আমার হক সম্পত্তি পেতে চাই।
এখন সম্পত্তি নিয়ে নিলে ভবিষ্যতে যদি তেমন কোনো বিপদে পড়িস, তখন কোথায় যাবি?
ভবিষ্যতের কথা আল্লাহ জানেন। আর সত্যিই যদি আমার ভাগ্যে তেমন কিছু ঘটে, তা হলে মনে রাখবেন, না খেতে পেয়ে মরে গেলেও আপনার কাছে এসে হাত পাতব না।
নূরুদ্দিন মিয়া রাগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, তুই যে সম্পত্তির দাবি করছিস, আকবর হোসেন জানে?
হা জানে।
জানতাম আকবর হোসেনের দীল ও দৌলত দু’টোই আছে। এখন জানলাম, দৌলত থাকলেও দীল নেই। তার দীল এত ছোট, কখনো ভাবিনি।
আল্লাহ তাকে দল-দৌলত দু’টোই দিয়েছেন। সে এই সম্পত্তি আশা করেনি। কিন্তু আমি আমার হক সম্পত্তি ছাড়ব কেন? আর আপনারাই বা দিতে চাচ্ছেন না কেন?
নূরুদ্দিন আরো রেগে গিয়ে বললেন, আমি কী বলেছি দেব না?
বড় চাচাকে রেগে যেতে দেখে রিয়াজুল বলল, বেয়াদবি নেবেন না, আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।
নূরুদ্দিন মিয়া গম্ভীর স্বরে বললেন, বল কী বলবে।
রিয়াজুল বলল, আল্লাহ কোরআন পাকে বাবার সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়েদের অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এক ছেলে যা পাবে, এক মেয়ে পাবে তার অর্ধেক। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইয়েরা বোনদেরকে তাদের ন্যায্য সম্পত্তি থেকে নানান ছুতায় বঞ্চিত করে। এটা যে আল্লাহর আইনকে অমান্য করা হল, তা চিন্তা করে না। যারা একজনের হক সম্পত্তি না-হক করে ভোগ দখল করে, তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। এটাও কোরআন হাদিসের কথা। ইসলামের বিধান হল, বাবা মারা যাওয়ার পর ছেলেরা যখন সম্পত্তি ভাগ করে নেবে তখন মেয়েদের অংশও তাদের দিয়ে দিতে হবে। তবে কেউ যদি না নিয়ে স্বেচ্ছায় ভাইদের দিয়ে দেয়, তাতেও কোনো নিষেধ নেই। তবু তাদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেওয়াই ভালো। কারণ ভবিষ্যতে বোনের ছেলে মেয়েরা মায়ের সম্পত্তি দাবি করতে পারে। তা ছাড়া আজকাল পুরুষরা মেয়েদেরকে মুল্যায়ন করছে না। তাদের প্রতি কর্তব্য আদায়ও করছে না। যার ফলে দিনের পর দিন সমাজে মেয়েদের মূল্য অনেক কমে যাচ্ছে। তারা পুরুষদের কাছ থেকে ন্যায্য অধিকার না পেয়ে তা আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমে শ্লোগান দিচ্ছে, বিভিন্ন সভা সমিতি করছে। আবার অনেক এন.জি.ও.দের খপ্পরে পড়ে বেপর্দা হয়ে শালীনতা হারাচ্ছে। তাদেরকে অনুকরণ অনুসরণ করে ধর্মান্তরিতও হচ্ছে। একরকম পুরুষরাই তাদেরকে ঐ পথে যেতে বাধ্য করছে। মেয়েরা যদি তাদের ন্যায্য অধিকার তার স্বামীদের ও ভাইদের তথা পরিবারের সবার কাছ থেকে পেত, তা হলে তারা পথে নামত না। এবং ইসলামকে পরিত্যাগ করে এন.জি.ও.দের পাল্লায় পড়ত না। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর শালা-সম্বন্ধীরা বোনেদের হক দিচ্ছে না। তাই জামাই বা জামাই-এর বাবা-ভাইয়েরা বিয়ের সময় মোটা যৌতুক দাবি করছে। সব থেকে বড় অপরাধ পুরুষরা করছে, তারা মেয়েদেরকে তাদের অধিকার সম্বন্ধে অজ্ঞ করে রেখে বাদী-দাসীর মতো খাটাচ্ছে। তারা যে, পুরুষের অর্ধেক, তা স্বীকার না করে তাদের প্রতি ইতর প্রাণীর মতো ব্যবহার করছে। এর জন্য পুরুষদেরকে কাল কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহি করতে হবে। আমরা মুসলমান হয়েও ইসলামের তথা কোরআন-হাদিসের বিধান মতো ভাইয়েরা বোনেদের ন্যায্য সম্পত্তি না দিয়ে, স্বামীরা স্ত্রীদেরকে তাদের দেনমোহরের টাকা না দিয়ে জঘন্যতর অপরাধ করছি। যারা আল্লাহ, কবর ও হাসরকে বিশ্বাস করে ও ভয় করে, তারা কোনোদিন এইরূপ জঘন্য অপরাধ করতে পারে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, ডেথ ইজ ইমপেন্ডিং ওভার আওয়ার হেড। অর্থাৎ মৃত্যু আমাদের মাথার উপর ঝুলছে। যে কোনো সময়ে ফাঁসির রশির মতো গলায় চেপে ধরবে। তা সত্বেও আমরা মৃত্যু ভুলে, আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) এর বাণী ভুলে দুনিয়াদারীর মোহে হাবুডুবু খাচ্ছি। দুনিয়াদারীর জন্য আমরা যে কোনো জঘন্যতর অপরাধ করাছ। অথচ শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হলে তার এক কানাকড়িও মূল্য থাকবে না। আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি, ফুফুর অংশ মতো সম্পত্তি তাকে দিয়ে দিন। আর একটা কথা, শুনলাম জমির রেকর্ড হচ্ছে। আপনারা দাদাজীর সম্পত্তি শুধু দু’ভাইয়ের নামে রেকর্ড করাচ্ছেন। আমার মরহুম আব্বার নাম ও ফুফুর নামে করাচ্ছেন না, এই কথাটা কী সত্য?