মোসারেফ হোসেন কান্না সামলাতে পারলেন না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, কি আর বলব বাবা, আমাদের বড় ছেলেকে আল্লাহ তুলে নিয়ে তোমাকে পাঠিয়েছেন। শুধু ছেলে হিসাবে নয় আল্লাহর দান হিসাবেও গ্রহণ করব। এযে আমাদের কতবড় ভাগ্য তা আল্লাহপাকই জানেন। তারপর আসমাকে বললেন, সালেহা ও জাহিদকে ডেকে নিয়ে আয়।
আসমা রুমের বাইরে এসে সালেহাকে দেখে বলল, জাহিদ কোথায়?
সালেহা বলল, বোধ হয় খেলতে গেছে।
তুই আমার সঙ্গে আয় বলে আসমা তাকে নিয়ে রুমে ঢুকে আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, জাহিদ খেলতে গেছে।
মোসারেফ হোসেন বললেন, রিয়াজুল তোদের বড় ভাইয়ের মতো, সালাম কর।
আসমা ও সালেহা একে একে সালাম করল।
রিয়াজুল মাথায় হাত ছুঁয়ে চুমো খেয়ে বলল, তোমাদের বড় ভাইয়ের হক আদায় করার তওফিক আল্লাহ আমাকে যেন দেন। তারপর আসমাকে জিজ্ঞেস করল, সালেহা কী আর স্কুলে যায় না?
না।
সামনেই জানুয়ারী মাস। সেই সময় ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিও। টাকার জন্য চিন্তা করে না। আবার জিজ্ঞেস করল, চাচাকে কোন্ ডাক্তার চিকিৎসা করছেন?
ডাক্তারের নাম বলে আসমা বলল, টাকার অভাবে প্রায় একবছর চিকিৎসা বন্ধ। টাকা হাতে এলে মাঝে মাঝে আগের প্রেসক্রিপসানের ঔষধ নিয়ে আসি।
ঠিক আছে, আমি ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে যা করার করব। প্রয়োজন হলে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাব। তারপর মাহমুদা বিবির দিকে তাকিয়ে বলল, চাচি আম্মা আপনারা দোওয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমার মনের বাসনা পূরণ করেন।
মাহমুদা বিবি সবকিছু শুনে ঘোমটার ভিতর চোখের পানি ফেলছিলেন। চোখ মুছে বললেন, আল্লাহ তোমাকে আমাদের উপর রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছেন। তার দরবারে জানাই হাজার হাজার শুকরিয়া। তিনি তোমাকে হায়াতে তৈয়েবা দান করুন। তোমার মনের নেক মকসুদ পূরণ করুন। তোমাকে সুখি করুন।
রিয়াজুল বলল, এখন আসি মাগরিবের সময় হয়ে আসছে।
মোসারেফ হোসেন বললেন, একটু চা খেয়ে গেলে হত না বাবা?
না চাচা, নামাযের দেরি হয়ে যাবে। তারপর সালাম বিনিময় করে আসমাকে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস।
পুকুর পাড়ে এসে বলল, আমি যখন আসি তখন যে ছেলেটার সঙ্গে তুমি কথা বলছিলে তার সঙ্গে পরিচয় হল। কে হয় তোমাদের?
আসমা থতমত খেয়ে কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারল না। সামলে নিয়ে বলল, দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই, মতি। আত্মীয়দের মধ্যে ও-ই আমাদের খোঁজ-খবর নেয়। মাস ছয়েক আগে চাকরী পেয়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিল। কাল এসে আমাদের খবর নিতে আজ এসেছিল।
মতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা জানার জন্য জিজ্ঞেস করল, অতক্ষণ ধরে কি কথা বলছিলে?
এই পুকুরটা এ বছর বিলি করব। তাই গ্রাহক দেখার কথা বলছিলাম।
তা আর করো না। যা করার আমিই করব ইনশাআল্লাহ। তারপর বলল, চাচা-চাচি যখন ছেলে বলে গ্রহণ করেছেন তখন তোমরাও নিশ্চয় বড় ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে?
আমি তো সেই প্রথম দিনেই করেছি।
তা হলে ভাইয়া বলে ডাকনি কেন?
লজ্জায়, তবে আব্বা আজ ভাঙ্গিয়ে দিয়েছেন।
এমন সময় জাহিদকে পাশ কেটে চলে যেতে দেখে আসমা বলল, এই জাহিদ শোন।
মাহমুদা বিবি ছেলেমেয়েদের আদব কায়দা শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছেন। বড়দের সঙ্গে দেখা হলে সালাম দিতে শিখিয়েছেন। বড়রা যখন কথা বলবে তখন ছোটদের সেখানে থাকা নিষেধ করেছেন। তাই বড় বুবুকে একজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। বড় বুবুর কথা শুনে দাঁড়িয়ে রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে সালাম দিল।
রিয়াজুল সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তুমিই তা হলে জাহিদ? খেলতে গিয়েছিলে বুঝি?
জ্বি।
ঠিক আছে যাও।
জাহিদ যেতে উদ্যত হলে আসমা বলল, ইনি আমাদের বড় ভাই, কদমবুসি কর।
জাহিদ অবাক হয়ে একবার রিয়াজুলের দিকে আর একবার আসমার দিকে তাকাতে লাগল।
কিরে কদমবুসি করতে বললাম না?
জাহিদ কদমবুসি করতে এগিয়ে এলে রিয়াজুল বসে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, থাক তোমাকে আর কদমবুসি করতে হবে না। কোন ক্লাশে পড়?
সিক্সে।
রোল নাম্বার কত?
দুই।
আরো ভালো করে পড়াশোনা করবে, তা হলে এক নাম্বারে এসে পড়বে।
জ্বি করব।
এমন সময় আজান শুনে জিজ্ঞেস করল, তুমি নামায পড়তে জান?
জ্বি জানি। কোরআনও পড়তে জানি। আম্মা শিখিয়েছেন।
তা হলে যাও কাপড় পাল্টে এস, মসজিদে যাবে।
আপনি যান, আমি ঘরে পড়ব।
কেন?
আমার একটা লুঙ্গি, তার অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। তাই বড় বুবু ঘরে পড়তে বলেছে।
ঠিক আছে তুমি যাও, আমি তোমার বড় বুবুকে লুঙ্গি কিনে দিতে বলব।
জাহিদ আর কিছু না বলে চলে গেল।
জাহিদের কথায় আসমা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ছিল। রিয়াজুল বুঝতে পেরে বলল, আল্লাহর কী কুদরত দেখ আসমা, কারো আট দশটা জামা কাপড়, আবার কারো পরার উপযুক্ত একটাও নেই। কেউ উদ্বৃত্ত খাবার ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে, আবার কেউ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।
আসমা বলল, আযান হয়ে গেছে, নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
ও হ্যাঁ যাচ্ছি। তারপর আসি বলে সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
আসমা ঘাট থেকে অযু করে ঘরে এস নামাযে দাঁড়াল।
মোসারেফ হোসেনের বারান্দাসহ টিনসেড দুই রুমের ঘর। একটায় স্বামী স্ত্রী থাকেন। অন্যটায় আসমা দুই ভাই-বোনকে নিয়ে ঘুমায়। বারান্দায় অর্ধেকটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে আসমা একটা রুম করেছে। সেখানে সে সকালে ও দুপুরের পর স্কুলের কয়েকটা ছেলে মেয়েকে প্রাইভেট পড়ায়।