মতি খুব অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? তা হলে তো তিনি খুব ধার্মিক?
শুধু ধার্মিক নন, উচ্চ শিক্ষিতও।
উচ্চ শিক্ষিত ও ধার্মিক মানুষের মন খুব উদার হয়। আমি আজই তার সঙ্গে দেখা করব।
মতি ভাই, ভাবছি এ বছর পুকুরটা বিলি করব। তুমি খদ্দের দেখ।
ঠিক আছে দেখব, এবার আসি। তারপর সালাম বিনিময় করে মতি চলে গেল।
রিয়াজুল এতক্ষন রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। মতি এগিয়ে এলে সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে মতি বলল, আপনাকে তো চিনতে পারছি না?
আমি রিয়াজুল। মিয়া বাড়ির ছেলে। আমার বাবার নাম মরহুম সালাউদ্দিন মিয়া। ছোট বেলা থেকে ঢাকায় খালার কাছে মানুষ হয়েছি। কয়েকদিন হল এসেছি। আপনি?
মতি বুঝতে পারল, এর কথাই আসমা বলেছে। বলল, আমি এই গ্রামেরই ছেলে। ঢাকায় চাকরি করি। কাল এসেছি। মোসারেফ হোসেন আমার দূর সম্পর্কের চাচা হন। উনাকে দেখতে গিয়েছিলাম। আপনার কথা কিছুক্ষণ আগে আসমার কাছে শুনলাম। আপনি তাকে পাষণ্ড চেয়ারম্যানের ছেলের হাত থেকে কয়েকদিন আগে রক্ষা করেছেন ও মোসারেফ চাচার চিকিৎসার জন্য সাহায্য করেছেন তা-ও শুনেছি। দেখা হয়ে ভালই হল। নচেৎ আমি নিজেই আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য যেতাম। এখন আসি, পরে আবার দেখা হবে। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
রিয়াজুল আসমাদের উঠোনে এসে আসমার নাম ধরে ডাকল।
আসমা ঘরে এসে আব্বা ও আম্মাকে এবছর পুকুর বিলি করার কথা বলছি। তার নাম ধরে কেউ ডাকছে শুনে মাকে বলল, তুমি এখান থেকে যাও, কে যেন আব্বার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তারপর বাইরে এসে রিয়াজুলকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, আপনি?
রিয়াজুল সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?
বারে, বিশ্বাস হবে না কেন? কিছুক্ষণ আগে আব্বা আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। বললেন, ছেলেটা তিন চারদিন এল না কেন বলতে পারিস?
তুমি কী বললে?
বললাম, হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত আছেন।
মাহমুদা বিবি মেয়ে বলা সত্ত্বেও রিয়াজুলকে দেখার জন্য কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিলেন। প্রথম দিন তার মুখ দেখেননি। রিয়াজুলের গুণগান আসমা ও স্বামীর মুখে শুনে আজ না দেখে থাকতে পারলেন না।
আসমা মাকে আব্বার রুম থেকে বেরোতে দেখেনি। মাকে বেরোবার সময় দিয়ে রিয়াজুলের সঙ্গে বাইরেই কথা বলছিল। তবু যখন মাকে রুম থেকে বেরোতে দেখল না তখন রিয়াজুলকে বলল, একটু অপেক্ষা করুন, আসছি। তারপর আব্বার রুমে গিয়ে মাকে বলল, তুমি এখনো রয়েছ?
মাহমুদা বিবি ঘোমটা টেনে পাশের রুমে চলে গেলেন।
আসমা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রিয়াজুলকে আসতে বলল।
রিয়াজুল রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, চাচা কেমন আছেন?
মোসারেফ হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আল্লাহর রহমতে একরকম আছি। তা তুমি কয়েকদিন আসনি কেন বাবা?
ছোট চাচার সঙ্গে ফুফুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। আজ দুপুরের দিকে ফিরেছি।
তাই বল, আমি মনে করেছিলাম তোমার কোনো কিছু হল কিনা। তারপর বললেন, তোমার ফুফু খুব ভালো। তার স্বামী আকবর হোসেনও খুব ভালো। এখানে এলেই আমাকে দেখতে আসেন। জান বাবা, তোমার ফুফুর ঘটকালি আমিই করেছিলাম। তা ওরা সবাই ভালো আছে তো?
জ্বি ভালো আছেন। ফুফু ও ওঁর বড় ছেলে রফিক আমাদের সঙ্গে এসেছেন।
তাই নাকি! তানজিলাকে বলো আমাকে যেন একবার দেখা দিয়ে যায়।
জ্বি বলব। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আমি একটা আবদার করব, বলুন রাখবেন?
মোসারেফ হোসেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার আবদার রাখার মতো ক্ষমতা আমার কী আছে বাবা? তবু তুমি বল, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।
রিয়াজুল আসমাকে বলল, চাচি আম্মাকে এখানে নিয়ে এস।
আসমা জানে আম্মা রিয়াজুলের সামনে আসবে না। তাই ইতস্ততঃ করতে লাগল।
রিয়াজুল বলল, কই নিয়ে এস।
মোসারেফ হোসেন মেয়ের ইতস্তত করার কারণ বুঝতে পেরে বললেন, কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর মাকে নিয়ে আয়।
আসমা বাইরে এসে দেখল, মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল, আব্বা যেতে বললেন। তুমি ঘোমটা দিয়ে চল। তা হলে কোনো গোনাহ হবে না।
মাহমুদা বিবি লম্বা ঘোমটা দিয়ে ভিতরে এসে স্বামীর পায়ের দিকে দাঁড়ালেন।
রিয়াজুল সালাম দিয়ে প্রথমে মোসারেফ হোসেনকে ও পরে মাহমুদা বিবিকে কদমবুসি করে ভিজে গলায় বলল, আমি মা-বাবা কি জিনিস জানি না। ছোট বেলা থেকে খালা খালুকে মা-বাবা জেনে এসেছি। এমন কি এখানে আসার কিছুদিন আগে পর্যন্ত নিজের মা-বাবার কথা জানতাম না। এখানে এসে ছোট চাচার কাছে আপনাদের পরিচয় পেয়ে মনে হয়েছে আল্লাহ মা-বাবাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলেও আপনাদেরকে আমার মা-বাবা করে রেখেছেন। আমাকে কী আপনারা ছেলে হিসাবে গ্রহণ করবেন না?
রিয়াজুলের কথা শুনে মোসারেফ হোসেন ও মাহমুদফা বিবি অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। আর আসমা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। সালেহা পাশের রুমে ছিল। বুবু যখন রিয়াজুলের সঙ্গে কথা বলছিল তখন জানালা দিয়ে তাকে দেখছিল। রিয়াজুল ঘরে ঢুকে যেতে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। মা রুমে ঢুকলেও সে ঢুকেনি। সেও রিয়াজুলের কথা শুনে ভীষণ অবাক হল।
রিয়াজুল চোখ মুছে বলল, আপনারা কিছু বলছেন না কেন?