- বইয়ের নামঃ পল্লীবালা
- লেখকের নামঃ কাসেম বিন আবুবাকার
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-২. জয়নগর গ্রাম
পল্লীবালা – ইসলামিক প্রেমের উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
০১.
জয়নগর গ্রামের এমন কোনো ছোট বড় মেয়ে পুরুষ নেই, যে নাকি আসমাকে চেনে। আসমা খুব ডাকসেটে মেয়ে। ভয়-ডর বলতে কিছু নেই। সুন্দরী হলে কী হবে, দুষ্টমীতে ওস্তাদ। কোনো মেয়েকে তাদের পুকুর থেকে মাটির কলসিতে করে পানি নিয়ে যেতে দেখলে, সে বৌড়ী, ঝিউড়ী বা শাশুড়ী যেই হোক না কেন, ইটের টুকরো ছুঁড়ে তার কলসি ফুটো করে দেবেই। সেই জন্যে তাকে মায়ের কাছে অনেক বকুনী খেতে হয়। তবু তা। করবেই। মা মাহমুদা বিবি গরিব মেয়েদের অনেককে কলসি কেনার টাকা দেন। বাবা মোসারেফ হোসেন মেয়েকে রাগারাগি না করলেও দুষ্টুমী করতে নিষেধ করেন। তার কথাও শোনে না। বড় ভাই ইলিয়াস তার চেয়ে তিন বছরের বড়। সে মাঝে মধ্যে চড়-চাপটা দিলে তার সাথে হাতাহাতি করে। ছোটরা তাকে ভয় পায়, দেখলেই ছুটে পালায়। সমবয়সি ছেলে-মেয়েরাও ভয় করে। বড়রা তাকে এড়িয়ে চলে। কেউ যদি তার দিকে তাকায়, তা হলে তার সামনে গিয়ে গর্জে উঠবে, কী দেখছেন? ঘরে মা বোন নেই? আবার কোনোদিন তাকালে চোখ উপড়ে নেব।
তার চেয়ে দু’তিন বছরের বড় দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই মতি তাকে ভালবাসে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারেনি। একদিন সুযোগ পেয়ে বলল, আসমা তুই দেখতে খুব সুন্দরী, কিন্তু তোর স্বভাবটা এত খারাপ কেন?
ব্যাস, আর যায় কোথায়? কর্কশ কন্ঠে বলল, কেন? তোদের পাকা ধানে মই দিয়েছি নাকি? আমার স্বভাব কী খারাপ দেখেছিস তোকে বলতেই হবে। নচেৎ তোর একদিন কী আমার একদিন।
মতি বলল, এখন যা করছিস, সেটাই তার প্রমাণ।
আসমা তার মুখে খুব জোরে একটা ঘুঁসি মেরে বলল, তাতে তোর কী? তোর খাই না পরি?
ঘুঁসি খেয়ে মতির একটা দাঁত ভেঙ্গে গিয়ে মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল।
আসমা দেখেও গ্রাহ্য করল না। বলল, আবার যদি কোনোদিন আমার সাথে লাগিস, তা হলে বাকি দাঁতগুলোও ভেঙ্গে দেব।
মতি বলিষ্ঠ তরুণ। ইচ্ছা করলে প্রতিশোধ নিতে পারত। তা না করে খুব রাগের সাথে বলল, মেয়ে বলে পার পেয়ে গেলি, নচেৎ………….. কথাটা শেষ না করে চলে গেল।
ঘরের সবাই যখন জিজ্ঞেস করল, তোর দাঁত ভাঙ্গল কি করে, তখন লজ্জায় সত্য ঘটনা বলতে না পেরে বলল, হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, ওর সঙ্গে ভালবাসা করে বিয়ে করে প্রতিশোধ নেবে। তখন আসমা ক্লাস নাইনে পড়ে। তারপর থেকে মতি আসমার ধারে কাছে যায় না। তবে দূর থেকে লক্ষ্য করে।
মতির বাবার অবস্থা তেমন ভালো না হলেও চাষের ধানে সারা বছর একরকম টেনে টুনে চলে যায়। ওরা দু’ভাই তিন বোন। মতি সবার বড়। গত বছর এস.এস.সি. পাশ করে আর্থিক কারণে কলেজে পড়েনি। বাবার সঙ্গে চাষ-বাসের কাজ করে।
বছর দুই পরে যে বছর আসমা এস.এস.সি. পরীক্ষা দিল সেই বছর তার ভাই ইলিয়াস কুয়েতে চাকরি করতে গিয়ে তিন মাসের মধ্যে মারা গেল। লাশ ফেরৎ এলে তার বাবা মোসারেফ হোসেন দেখে স্ট্রোক করে পঙ্গু হয়ে গেলেন।
মতি সেদিন ইলিয়াসের দাফন-কাফনে সহযোগীতা করল। কয়েকদিন পর আমাদের বাড়িতে আসার সময় পুকুর পাড়ে তার সঙ্গে দেখা।
মতি কিছু বলার আগে আসমা বলে উঠল, কিরে মতি, দাঁত ভাঙ্গার প্রতিশোধ নিতে এসেছিস না কি?
মতি মৃদু হেসে বলল, তখন অবশ্য ভেবেছিলাম, সুযোগ পেলে নেব। পরে চিন্তা করে
দেখলাম, তুই আমার চেয়ে দু’তিন বছরের ছোট, তা ছাড়া দূর সম্পর্কের হলেও চাচাতো বোন। ছোট বোন অন্যায় করলে বড় ভাই হিসাবে মাফ করে দেওয়া উচিত। তাই সে কথা মনে না রেখে মাফ করে দিয়েছি।
আসমা বলল, সেদিন ঘরে এসে আমিও ভেবেছিলাম তোকে মারাটা অন্যায় হয়েছে, মাফ চেয়ে নেব। যাক, তুই মাফ করে দিয়েছিস শুনে খুশি হলাম।
একটা কথা বলব রাবি না বল?
না, কি বলবি বল।
আমি তোর চেয়ে বড়, তুমি করে বলতে পারিস না?
আসমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আর কিছু বলবি?
তুই বড় হয়েছিস, এস.এস.সি. পরীক্ষাও দিয়েছিস। আমি খারাপ কিছু বললাম কিনা ভেবে দেখ। ইলিয়াস মারা যেতে চাচা পঙ্গু হয়ে গেছেন। এবার তুই সংযত হ’! বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করতে শেখ। এখন আর পাড়ায় পাড়ায় ডগাং ডগাং করে ঘুরে বেড়ানোও তোর উচিত নয়।
আসমা ভিজে গলায় বলল, মতি ভাই তুমি ঠিক কথা বলেছ। পাড়ায় ঘোরা আমি বন্ধ করে দিয়েছি। তুমিও কিন্তু আমাকে তুমি করে বলবে।
মতি খুশি হয়ে বলল, ঠিক আছে, চলো চাচাকে দেখে আসি।
এরপর থেকে মতি প্রায় চাচাকে দেখতে এসে আসমার সঙ্গে গল্প করে। তাদের সংসারের বাইরের যাবতীয় কাজ করে দেয়। তাদের পুকুরে মাছ চাষের ও বিক্রি করার ব্যবস্থা করে। তাদের দুরাবস্থা দেখে দুঃখ পায়। যতটুকু পারে মাঝে মধ্যে মা-বাবার অগোচরে চাচার হাতে বিশ-পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সাহায্য করে।
আসমা জানতে পেরে একদিন বলল, মতি ভাই, আব্বাকে যে টাকা তুমি দাও, সেটা কোথায় পাও?
আমি মায়ের কাছ থেকে মাঝে মাঝে হাত খরচের জন্য কিছু কিছু চেয়ে নিই। খরচ না করে জমিয়ে চাচাকে দিয়ে যাই।
কেন দাও বলতো?
বারে, চাচার দুর্দিনে সাহায্য করাই তো উচিত।