সাবেরা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, তোমার কথার ওপর আমি কখনো কিছু বলব না। শুধু আমার এতটুকু অনুরোধ, আমাকে যদি তোমার মা-বাবা কোনো দিন মেনে না নেন অথবা ওঁনারা আমাকে ত্যাগ করার কথা বলে ওঁনাদের পছন্দমতো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান, তা হলে বিয়ে করে ওঁনাদের সুখী করো; কিন্তু আমাকে ত্যাগ করো না। ছ’মাসে হোক, বছরে হোক বা দু’বছর পরে হোক অন্তত একদিনের জন্যে হলেও আমাকে দেখা দিতে এসো।
রাকিব তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলেছিল, আমি তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি, জীবন গেলেও তোমাকে ত্যাগ করতে পারব না। প্রয়োজনে মা-বাবাকে ত্যাগ করে তোমার কাছে চলে আসব। তারপর আদর করে বিদায় নিয়ে চলে আসে।
ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত মা-বাবাকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তিন চারবার সাবেরার কাছে এসে দু’একদিন করে থেকে গেছে। পরীক্ষার পর বেশ কয়েকদিন থাকার জন্য বন্ধুর দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা মা-বাবাকে জানাবে যখন ভাবছিল তখন একদিন কানাডা থেকে ফোন এল তার খালা মৃত্যুশয্যায়। বাবার অফিসের জরুরি কাজ থাকায় মাকে নিয়ে কানাডা যেতে হল রাকিবকে। যাওয়ার আগে সাবেরার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে, সময় করে উঠতে পারে নি। তাই একটা চিঠিতে সব কিছু লিখে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা জানিয়ে পোস্ট করে গেল। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, তার খালা মৃত্যুশয্যা থেকে বেঁচে গেলেও ঢাকা ফেরার আগের দিন রোড এ্যাকসিডেন্টে রাকিব মারা গেল।
পরীক্ষার তিন মাস আগে রাকিব যখন সাবেরার কাছে এসেছিল তখন থেকে সাবেরার প্র্যাগনেন্সি শুরু। তিন মাস পর সিওর হয়ে সাবেরা সে কথা চিঠি দিয়ে রাকিবকে জানিয়েছিল। রাকিব চিঠি পড়ে খুব আনন্দিত হলেও তখন পরীক্ষার পড়ার চাপে চিঠির উত্তর দিতে পারে নি। ভেবেছিল পরীক্ষার পর যাবে, তাই উত্তর না দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মাকে নিয়ে কানাডা যেতে হল। তাই যাওয়ার আগে যে চিঠি দিয়েছিল, তাতে বাবা হতে যাচ্ছে জেনে আনন্দিত হওয়ার কথা জানিয়েছিল।
সেই চিঠি পড়ে স্বামী আনন্দিত হয়েছে জেনে সাবেরা যতটা না খুশি হল, তার সঙ্গে দেখা না করে কানাডা চলে গেছে জেনে অনেক বেশি দুঃখ পেল। তারপর এক মাস দু’মাস করে যখন ছ’মাস পার হয়ে গেল অথচ রাকিব এল না, এমনকি একটা চিঠিও দিল না তখন সাবেরা অস্থির হয়ে উঠল। শহরের বড়লোকের ছেলেদের স্বভাব চরিত্রের কথা যতটুকু শুনেছিল, সেসব চিন্তা করে খুব আতঙ্কিত হল। ভাবল, রাকিবকে যতটুকু জেনেছে, সে তো অন্য পাঁচটা ছেলের মতো নয়। তবু কেন এতদিন তার খোঁজ-খবর নেই? তা হলে কি কানাডাতে তার কোনো বিপদ হল? না অন্য ছেলেদের মতো সেখানকার কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সুখের সংসার করছে? এইসব চিন্তা করতে করতে সাবেরার শরীর বেশ ভেঙ্গে পড়ল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর স্বামীর মঙ্গল কামনা করে ও তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগল।
জামাই এতদিন হয়ে গেল আসছে না দেখে আযীয মাস্টারও খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। দিন দিন মেয়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এতদিন হয়ে গেল জামাই আসছে না কেন বলতে পারিস?
সাবেরা ম্লান মুখে বলল, তা আমি কি করে বলব?
তোকে চিঠিপত্র দেয় নি?
না।
জামাইয়ের পরীক্ষা প্রায় ছ’মাস আগে শেষ হয়েছে, তবু আসছে না কেন? তোর সঙ্গে মনোমালিন্য হয় নি তো?
না আব্বা, ওসব কিছু হয় নি। পরীক্ষার পর আসবার কথা আমাকে চিঠিতে জানিয়েছিল। তারপর কানাডা যাওয়ার কথা বলল।
আযীয মাস্টার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, এতদিন তো আর সেখানে নেই? নিশ্চয় ফিরে এসেছে। তবু কেন আসছে না বুঝতে পারছি না।
সাবেরা বলল, তুমি একবার শিহাব ভাইয়ের কাছে যাও। মনে হয় সে এখন ঘরেই থাকে। তাকে জিজ্ঞেস করলে তোমার জামাইয়ের খবর পাওয়া যাবে।
আযীয মাস্টার মেয়ের কথা শুনে একটু স্বস্তি পেলেন। বললেন, তুই খুব ভালো কথা বলেছিস। আগেই কথাটা আমার মাথায় আসা উচিত ছিল। এক্ষুনি শিহাবের কাছে যাচ্ছি।
শিহাব ঘরেই ছিল। আযীয মাস্টারকে আসতে দেখেই বুঝতে পারল কেন এসেছেন। রাকিবের মৃত্যুর খবর অনেক আগে জেনেছে। জানার পর তার জন্য যতটা না দুঃখ পেয়েছে, সাবেরা ও তার বাবা জানলে আরো অনেক বেশি দুঃখ পাবে এমনকি সাবেরা হয়তো পাগল হয়ে যেতে পারে ভেবে খবরটা তাদেরকে জানায় নি। কাছে এলে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন স্যার?
আযীয মাস্টার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আল্লাহ একরকম রেখেছেন বাবা। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, রাকিবের খবর জান?
রাকিবের মৃত্যুর কথা কিভাবে বলবে শিহাব চিন্তা করতে লাগল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আযীয মাস্টার আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কিছুদিনের মধ্যে ঢাকা গিয়েছিলে? ছ’মাসের বেশি হয়ে গেল রাকিব আসে নি। কোনো চিঠিপত্রও দেয় নি। সে নাকি কানাডা গিয়েছিল, সেখানেই আছে না দেশে ফিরেছে সে কথা কি জান?
শিহাব চিন্তা করল, একদিন না একদিন তো স্যার কথাটা জানবেনই। মানুষের মৃত্যুর খবর কতদিন আর চাপা থাকে। তা ছাড়া স্যারকে তো মিথ্যে কিছু বলা যাবে না। শিহাব কিছু বলছে না দেখে আযীয মাস্টার অধৈর্য গলায় বললেন, হ্যাঁ না কিছু একটা তো বলবে?