রাকিব একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, তোর কথাই ঠিক, মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি। শুধু সাবেরার বিয়ের দিন পর্যন্ত নয়, যতদিন থাকার কথা বলে এসেছি, ততদিনই থাকব।
.
০২.
আজ শুক্রবার সাবেরার বিয়ের দিন। এই ক’দিন আযীয মাস্টারের কথামতো শিহাব রাকিবকে সঙ্গে নিয়ে সব কিছু ব্যবস্থা করেছে। বর ও বরযাত্রীদের বেলা দশটার সময় আসার কথা। আসার পর নাস্তা খাইয়ে বিয়ে পড়ানো হবে। তারপর জুমার নামায পড়ে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে মেয়ে বিদায় করা হবে। কিন্তু দশটার সময় তো এলই না, এমনকি জুমার নামাযের পরেও যখন বর ও বরযাত্রীরা এসে পৌঁছল না তখন আযীয মাস্টার খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। এবারে দু’পাশের গ্রামের অনেক লোকজন ও মাতব্বররাও এসেছেন। আযীয মাস্টার মাতব্বরদের জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি করা যায় বলুন তো?
তারা বললেন, হয়তো পথে কোনো বিপদ হয়েছে, তাই দেরি হচ্ছে। আপনি একজনকে পাঠিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতে বলুন।
এমন সময় একজন লোককে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেল। সবাই তার দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা এসে জানাল, নদী পার হওয়ার সময় বোটের ধাক্কা লেগে আমাদের নৌকা মাঝনদীতে ডুবে গেছে। অনেকে সাঁতরে পাড়ে উঠলেও বর ও বরযাত্রীদের বেশ কয়েকজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই খোঁজাখুঁজি করছে। বরের বাবা আমাকে পাঠালেন খবরটা দেয়ার জন্য। আরো বললেন, এই মেয়ে অপয়া, আমার ছেলে বেঁচে গেলেও এখানে আর বিয়ে করাবেন না।
কথাটা শুনে সবাই যতটা না অবাক হল, তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখ পেল। আযীয মাস্টার খুব মুষড়ে পড়লেন। খবরটা শুনে বাড়ির মেয়েরাও খুব দুঃখ পেল। আর সাবেরা শোনার পর অজ্ঞান হয়ে গেল। মেয়েরা তার মাথায় পানি ঢেলে ও চোখে-মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরালেও কিছুক্ষণ পরপর অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগল। কথাটা বাইরের লোকজন জানতে পেরে দুঃখ প্রকাশ ছাড়া তাদের আর কিছু করার রইল না।
দুই গ্রামের মাতব্বররা পরামর্শ করে আযীয মাস্টারকে বললেন, এখন আর কি করবেন? গ্রামের লোকজনদের খাওয়াবার ব্যবস্থা করুন। নচেৎ তারা চলে গেলে এত লোকের খাবার নষ্ট হবে।
আযীয মাস্টার চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমার একমাত্র মেয়ে সাবেরার কি হবে আপনারা বলে দিন।
আমরা কি বলতে পারি বলুন। আপনার মেয়ের ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। পরে আপনার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করব। এখন যা বললাম সেটা করলে ভালো হত না?
সেখানে শিহাব ও রাকিব ছিল। মাতব্বরদের কথা শুনে রাকিব বলল, আমি মাস্টার সাহেবের মেয়েকে এই মজলিসেই বিয়ে করব।
শিহাব ও তার বাবা আকরাম চৌধুরী এবং আযীয মাস্টার ছাড়া আর কেউ রাকিবকে চেনে না। তাই তারা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন।
আকরাম চৌধুরী ছেলের বন্ধু হিসাবে রাকিবের সব কিছু জানেন। বললেন, এ রকম হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেয়া কি তোমার ঠিক হল?
রাকিব বলল, হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিই নি। আমি চিন্তা-ভাবনা করেই নিয়েছি।
আকরাম চৌধুরী ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি মত?
শিহাব বলল, রাকিব এখানে আসার দু’দিন পর সাবেরাকে দেখে স্যারকে নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিল। তার আগেই সাবেরার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুনে আমার সঙ্গে বিয়ের এ্যারেঞ্জমেন্ট করেছে। বিয়ে ভেঙ্গে গেছে জেনে আবার প্রস্তাব দিচ্ছে। স্যার রাকিবের কাছ থেকে তার সম্পর্কে সব কিছু জেনেছেন। এখন তিনি যদি ওকে পছন্দ করেন, তা হলে বিয়েটা হয়ে যাওয়াই আমি ভালো মনে করি।
আকরাম চৌধুরী আযীয মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মতামত বলুন।
আযীয মাস্টার বললেন, আমার মাথার এখন ঠিক নেই, আপনারা যদি ভালো মনে করেন, আমার কিছু বলার নেই।
আমরা ভালো মনে করলে তো হবে না, আপনার মতামত কি তাই বলুন।
আযীয মাস্টার বললেন, সাবালিকা মেয়ের বিয়ের মতামত মেয়ে নিজেই দেবে, এটাই শরীয়তের হুকুম। যে বিয়েটা ভেঙ্গে গেল, সেটাতেও আমি ছেলের সব কিছু বলে সাবেরার মতামত নিয়েছিলাম। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আমি তার মতামত জেনে আসি। এই কথা বলে তিনি ভেতরে গিয়ে দেখলেন, সাবেরা তার মাকে জড়িয়ে ধরে ফেঁপাচ্ছে। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কান্না থামিয়ে মন দিয়ে আমার কথা শোন, বিয়ে-শাদি আল্লাহ যার সঙ্গে জোড়া করেছেন তার সঙ্গে হবেই। তাই হয়তো এই বিয়ে ভেঙ্গে গেল। তুমি তো শিহাবকে চেনো। তারপর রাকিবের পরিচয় দিয়ে বললেন, সে কয়েকদিন আগে তোমাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে জেনে শিহাবের সঙ্গে আজ দু’তিন দিন আমার কথামতো সব কিছু করেছে। বিয়ে ভেঙ্গে গেছে শুনে এখন আবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। দুই গ্রামের মাতব্বর ও লোকজন প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন। তুমি যদি রাজি হও, তা হলে এক্ষুনি বিয়ে পড়ানো হবে।
সাবেরা কান্না থামিয়ে আব্বার কথা শুনছিল। থেমে যেতে ভিজে গলায় বলল, আপনি ভালো মনে করে যেখানে যার সঙ্গে বিয়ে দেবেন, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
আলহামদুল্লিাহ বলে আযীয মাস্টার মজলিসে এসে বললেন, সাবেরা রাজি আছে। আপনারা বিয়ে পড়াবার ব্যবস্থা করুন।
বিয়ে হয়ে যাওয়ার দিন থেকে আরো পনের দিন রাকিব শ্বশুরবাড়িতে, মানে আযীয মাস্টারের বাড়িতে থাকল। তারপর শিহাবের সঙ্গে ঢাকায় ফিরে এল। বিয়ের পর সাবেরার সম্পর্কে যে প্ল্যান-প্রোগ্রামের কথা শিহাবকে বলেছিল, ঢাকায় ফেরার সময় সেসব সাবেরাকে বলে বলেছিল, তুমি শিহাবের ঢাকার ঠিকানায় চিঠি দিও। আমি শিহাবকে বলে রাখব, সে তোমার চিঠি আমাকে দেবে। আমিও তোমাকে চিঠি দেব। সামনে আমার ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার পর তোমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে হোস্টেলে রেখে কলেজে ভর্তি করে দেব। পরীক্ষার আগে আসতে পারব কি না সঠিক বলতে পারব না। তবে তোমাকে না দেখে বেশি দিন থাকতেও পারব না। আসার জন্য খুব চেষ্টা করব।