শিহাব বললেন, এ আপনি কি বলছেন চাচা? রিজিয়ার নানা সম্পর্কে যা বললেন, সে ব্যাপারে কিছু বলার নেই। কিন্তু আপনি আমার ও রিজিয়ার কাছে ক্ষমা চাইবেন কেন? রিজিয়া হল আপনার নাতনি। আপনার ওপর তার ক্ষোভ বা রাগ আগে ছিল কি না জানি না, কিন্তু এখন যে কিছুই নেই, তা আমি জানি। সে আপনার পায়ের সেবা করার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। আর আমি হলাম আপনার ছোট ছেলের বন্ধু। বন্ধুর বাবাকে নিজের বাবার মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে হয়, নিজের বাবার মতো সম্মান করতে হয়। পারতপক্ষে আমি আপনার ছেলের মতো। মায়ের কাছে জেনেছি, মা-বাবা অথবা মুরুব্বিদের দোষ-ক্রটি মনে রাখতে নেই। তাই সেদিন মনে খুব ব্যথা পেলেও মনে রাখি নি। তা ছাড়া আমাদের নবী করিম (সঃ) বলেছেন, অপরাধী নিজের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হলে ক্ষমার যোগ্য হয়ে যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন।
জাহিদ হাসান তার কথায় খুব খুশি হয়ে বললেন, রিজিয়াকে ডাক, ওকে দেখার জন্য খুব অস্থিরতা বোধ করছি।
অফিস থেকে এসে শিহাব যখন স্ত্রীকে জাহিদ হাসানের আসার কথা বলছিলেন তখন ফারিহা শুনেছে। তাড়াতাড়ি রিজিয়াকে কথাটা জানিয়ে তারা এতক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। তাকে ডাকার কথা শুনে রিজিয়া আর স্থির থাকতে পারল না। একরকম ছুটে এসে এই তো আপনার হতভাগী নাতনি রিজিয়া বলে দাদাজীর দু’পা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
জাহিদ হাসান হতবাক হয়ে নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে রাকিবের প্রতিচ্ছবি দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না।
কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে রিজিয়া বলল, জ্ঞান হওয়ার পর নানাজীর কাছে ঘটনা শুনে আপনাদের ওপর খুব ক্ষোভ ও রাগ হয়েছিল। এস.এস.সি. পাস করার পর নানাজী যখন কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যাসহ অন্যান্য ইসলামিক বই কিনে দিয়ে পড়তে বললেন তখন সেইসব পড়ে যে শিক্ষা পাই, সেই শিক্ষা মনের সব রকমের ক্ষোভ, রাগ ও দুঃখের কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে প্রত্যেক নামাযের পর আল্লাহর কাছে জানাতাম, তিনি যেন আপনাদের ক্ষমা করে দিয়ে আমাকে আপনাদের পায়ের সেবা করার সুযোগ দেন।
জাহিদ হাসান নাতনির মাথায় চুমো খেয়ে পাশে বসিয়ে বললেন, তুমি আল্লাহর খাস বান্দি। তাই তিনি তোমার দোয়া কবুল করে তোমাকে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তারপর শিহাবকে বললেন, আমার আর এক নাতনি কোথায়?
বাবা কিছু বলার আগে ফারিহা ভেতরে ঢুকে এই তো আপনার আর এক নাতনি বলে কদমবুসি করল।
জাহিদ হাসান তার মাথায়ও চুমো খেয়ে বললেন, থাক ভাই থাক। আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক। তোমার কথা হিমুর কাছে অনেক শুনেছি।
এমন সময় আরমান চৌধুরী সেখানে এসে সালাম দিয়ে বললেন, আমি শিহাবের শ্বশুর।
জাহিদ হাসান সালামের উত্তর দিয়ে দাঁড়িয়ে হ্যাঁন্ডসেক করার জন্য ডান হাত বাড়ালেন।
আরমান চৌধুরী দুই হাতে ওনার হাতটা ধরে বললেন, আপনিও দুই হাত দিয়ে আমার হাত ধরুন। ধরার পর বললেন, আমার চোখে চোখ রেখে বলুন আল্লাহুমাগ ফেরলি। অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। এটাকে মুসাফাহা বলে। মুসাফাহা হল ইসলামী প্রথা। আর হ্যাঁন্ডসেক হল বিধর্মীদের প্রথা। আমরা মুসলমান, আমাদের ইসলামী প্রথাই তো মেনে চলা উচিত, তাই না?
জাহিদ হাসান এসব জানতেন না। তাই লজ্জিত স্বরে বললেন, হ্যাঁ উচিত।
আরমান চৌধুরী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জাহিদ হাসানকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর দুই নাতনিকে উদ্দেশ করে বললেন, দাদুকে পেয়ে খুশিতে নাস্তা খাওয়াবার কথা ভুলে গেছিস নাকি? যা, তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা কর।
নাস্তা খাওয়ার পর আরমান চৌধুরী নাতনিদের বললেন, তোমরা গিয়ে আরিফাঁকে পাঠিয়ে দাও।
কিছুক্ষণের মধ্যে আরিফা বেগম এসে জাহিদ হাসানের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বাবার পাশে বসলেন।
জাহিদ হাসানকে উদ্দেশ করে আরমান চৌধুরী বললেন, এ হল আমার মেয়ে। তারপর বললেন, আমি শিহাবের কাছে সব কিছু শুনেছি। আপনি তো ইচ্ছা করলে রিজিয়ার আসল পরিচয় ছেলে-বৌমাকে জানিয়ে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।
জাহিদ হাসান বললেন, হ্যাঁ, পারি। কিন্তু আমি তা করব না। কারণ আমার ছেলে-বৌমাকে আমি চিনি। তারা আভিজাত্যের অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে আছে এবং ধনী হওয়া সত্ত্বেও বন্ধুর সমস্ত সম্পত্তির লোভে তার একমাত্র মেয়েকে বৌ করতে চায়। আমি রিজিয়াকে নাতবৌ করে তাদেরকে শিক্ষা দিতে চাই। আর সেইজন্য হিমুর সঙ্গে আলাপ করে একটা প্ল্যানও ঠিক করেছি।
আরমান চৌধুরী বললেন, প্ল্যানটা বলুন।
শিহাবকে আমার ছেলে ও বৌমা চেনে; কিন্তু তারা বাসার ঠিকানা জানে। আমি তাদের কাছে এই ঠিকানা জানিয়ে সুলতানার জন্য প্রস্তাব দেব। রিজিয়ার নতুন নাম হবে সুলতানা। হিমুর মা-বাবাকে এনে রিজিয়াকে দেখাব। হিমুর মা একবার মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখেছে। দেখে যদি রিজিয়াকে চিনে ফেলে তখন বলব, এ রিজিয়া নয়, সুলতানা। অনেক ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ে দেখতে প্রায় একই রকম হয়। তারপর তারা যাতে রিজিয়াকে বৌ করতে রাজি হয়, সেরকম ব্যবস্থা আমি করব। তবে বিয়ে পড়াবার আগে পর্যন্ত শিহাব তাদের সামনে আসবে না। আর রিজিয়াকে শিখিয়ে দিতে হবে দেখতে এসে তারা যদি নাম জিজ্ঞেস করে তখন যেন নতুন নাম সুলতানা বলে। তারপর বললেন, আমি একজন মুফতির কাছে জেনেছি, বাবা বেঁচে থাকতে ছেলে মারা গেলে ছেলের ঘরের নাতি-নাতনিরা দাদার সম্পত্তি থেকে মাহরুম হয়ে যায়। তবে দাদা ইচ্ছা করলে কিছু সম্পত্তি নাতি-নাতনিকে দিতে পারেন। এটাও ইসলামে জায়েজ আছে। তাই বিয়ের আগে আমি আমার বাড়িটার অর্ধেক অংশ রিজিয়ার নামে লিখে দেব। তা হলে ওদের বিয়ের পর রাগিব রিজিয়ার আসল পরিচয় জেনে যদি ছেলে-বৌকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়, তখন আর তা পারবে না।