তোমরা হলে ভাই মডার্ন যুগের শিক্ষিত মহিলা, আর আমি হলাম সেকেলে অল্পশিক্ষিত বুড়ো, তোমাদের সঙ্গে যুক্তিতে কি আর পারব?
হার যখন স্বীকার করলেন তখন আর কোনো কথা না বলে খেতে শুরু করুন। এমনিতেই তো আপনার নাস্তার টাইম দশ মিনিট লেট হয়ে গেছে।
নাস্তা খাওয়ার পর আরমান চৌধুরী হিমুর সঙ্গে তাদের পারিবারিক ও তার এম অফ লাইফ সম্পর্কে আলাপ করে খুশি হয়ে বললেন, তুমি বসো, ফারিহার মা-বাবা তোমাকে আসতে বলেছে। তারা হয়তো এবার আসবে। আমি এখন যাই বলে চলে গেলেন।
মিনিট পাঁচেক পর শিহাব ড্রইংরুমে ঢুকেই সালাম দিলেন।
হিমু জানত ছোটরাই বড়দের সালাম দেয়। তাই শিহাব চাচা আগে সালাম দিতে লজ্জা পেয়ে দাঁড়িয়ে সেও সালাম দিল।
শিহাব তাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, ছোট বড় যে কেউ আগে সালাম দিলে শুধু সালামের উত্তর দিতে হয়। পাল্টা তাকে সালাম দেয়া বেদাত। অর্থাৎ যা ইসলামের বিধানে নেই অথচ নিজের ইচ্ছায় কোনো নতুন নিয়মের প্রচলন করা। এসব কথা থাক, যে কারণে তোমাকে আসতে বলেছি সে ব্যাপারে আলাপ করা যাক। তুমি আমার বন্ধুর বড় ভাইয়ের ছেলে আর রিজিয়া আমার বন্ধুর মেয়ে ও আমাদের গ্রামের মেয়ে। তোমাদের দুজনের ভালোমন্দ চিন্তা করা আমার কর্তব্য। আমার বড় মেয়ে ফারিহার কাছে তোমার ও রিজিয়ার সম্পর্কে সব কিছু শুনেছি। কিন্তু তুমি কি জান, শিশু রিজিয়াকে যখন তার নানা ও আমি তোমার দাদার কাছে দিতে এসেছিলাম, তখন শুধু রিজিয়ার নানাকে নয়, আমি তোমার চাচার অন্তরঙ্গ বন্ধু জানা সত্ত্বেও তিনি ও তোমার বাবা আমাকে অবিশ্বাস করে দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
হিমু বলল, জি জানি।
শিহাব আবার বলল, যে রিজিয়াকে তার নানা শত অভাবের মাঝে না খেয়ে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করিয়েছিলেন, যাকে তোমার দাদাজী ও বাবা স্বীকৃতি দেন নি, তাকে কি তারা মেনে নেবেন? না ঘরে তুলবেন? আমার তো মনে হয়, তা তারা করবেন না। আর আমারও কি উচিত হবে, তাদের বাড়ির ছেলের সঙ্গে রিজিয়ার বিয়ে দেয়া? কখনই উচিত হবে না। আমার একটা কথার উত্তর দাও তো, শুনেছি তুমি বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে রিজিয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ, কিন্তু তার ও তার মা বাবার পুরো ইতিহাস জান কি?
হিমু বলল, জি জানি।
রিজিয়ার পরিচয় তোমার মা-বাবা, দাদা-দাদি জানেন?
দাদা-দাদি জানেন, মা বাবা জানেন না। তবে তারা শুধু এতটুকু জানেন, রিজিয়া পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের এতিম মেয়ে।
তারা কি রিজিয়াকে বৌ করতে রাজি আছেন?
মা-বাবা রাজি নন, দাদা-দাদি রাজি আছেন। ওঁনারা শিশু রিজিয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক, কিন্তু পরে দাদাজী অনুতপ্ত হয়েছিলেন। এখন আমার কাছে রিজিয়ার সব কিছু শুনে আরো বেশি অনুতপ্ত হয়েছেন এবং তাকে দেখার জন্য খুব অস্থির হয়ে আছেন। আজ ওনাকে আসতে বলেছিলাম। বললেন, রাকিবের বন্ধুকে সেদিন অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, এখন তার কাছে ও রিজিয়ার কাছে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াব।
তাই যদি হয়, তা হলে তো উনি ছেলে বৌকে রিজিয়ার আসল পরিচয় জানিয়ে রাজি করাতে পারেন! আর তুমিও রিজিয়ার আসল পরিচয় মা-বাবাকে জানাতে পারতে। জানার পর তারা হয়তো রাজি হতেন।
দাদাজী কেন জানান নি, তা আমি জানি না। আর আমি জানায় নি, কারণ আমার মা-বাবাকে আমি ভালোভাবেই জানি, তারা ধনের ও আভিজাত্যের অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে গেছেন। গরিবদের তারা মানুষ বলে মনেই করেন না। তারা কি রিজিয়ার আসল পরিচয় জেনে রাজি হবেন? কিছুতেই হবেন না। তাই আমি রিজিয়াকে বিয়ে করে তাদের সেই ধনের ও আভিজাত্যের অহঙ্কার চূর্ণ করে দিতে চাই।
তোমার উদ্দেশ্য ভালো হলেও এটা করা তোমার উচিত হবে না। কারণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) মা-বাবা যতই খারাপ হন না কেন, তবু তাদের মনে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন।
তা হলে আপনিই বলুন, আমার কি করা উচিত।
তুমি কি ইসলামের ওপর পড়াশোনা করেছ?
এতদিন করি নি। কিছুদিন আগে রিজিয়া আমাকে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে বলে। তখন থেকে ইসলামের ওপর বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়তে শুরু করেছি।
তোমার চাচার সঙ্গে যখন আমার বন্ধুত্ব হয় এবং তোমাদের বাসায় যাতায়াত করতাম তখন কেউ নামায রোযা করতেন না। আমি তোমার চাচাকে ইসলামী বই পড়িয়ে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত করি এবং কিছুদিনের মধ্যে ইসলামের বিধান মেনে চলতে শুরু করে। এখন তোমাদের বাসার কেউ কি নামায-রোযা করে না?
জি, না?
তুমিও কর না?
চাচাকে যেমন আপনি ইসলামী বই-পুস্তক পড়িয়ে ইসলামে অনুরক্ত করে নামায-রোযা ধরিয়েছিলেন, তেমনি রিজিয়াও আমাকে তাই করেছে। আজ ফজর থেকে নামায পড়তে শুরু করেছি। ইনশাআল্লাহ আগামী রমযান মাসে রোযাও রাখব।
আল্লাহ সবাইকে ইসলাম বোঝার ও ইসলামের বিধান মেনে চলার তওফিক দান করুন। তোমাকে নামায-রোযার কথা জিজ্ঞেস করলাম বলে মনে কিছু করো না। কেন জিজ্ঞেস করলাম জান, যারা এগুলো করে না, তাদের বাড়িতে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেয়া কোনো মা-বাবার উচিত নয়। জেনে রেখো, ইসলামকে যে জানে না এবং ইসলামের বিধি-বিধান যে মেনে চলে না, মুসলমানের ঘরে জন্মালেও সে প্রকৃত মুসলমান নয়।