শিহাব আরিফা বেগমকে বিয়ে করার পর যখন শান্তিনগরে বাড়ি করে স্ত্রীকে নিয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন তখন আরমান চৌধুরী জামাইকে বলেছিলেন, আরিফা আমাদের একমাত্র নয়নের মণি। তাই এই বাড়ি ও অন্যান্য সব কিছু ওর নামে লিখে দিয়েছি। তবু যদি তুমি আরিফাঁকে নিয়ে তোমার বাড়িতে যেতে চাও বাধা দেব না। শুধু এতটুকু বলব, ওকে ছেড়ে থাকতে আমাদের খুব কষ্ট হবে।
সেখানে শিহাবের শাশুড়িও ছিলেন। স্বামী থেমে যেতে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, তোমার শ্বশুরের সঙ্গে আমি একমত। তা ছাড়া আমাদের বহুদিনের আশা, নাতি-নাতনিদের মানুষ করব, তাদের খেলাধুলার সঙ্গী হব, তাদেরকে নিয়ে বেড়াব, আনন্দ করব। আমাদের সেই আশা ও আনন্দকে বঞ্চিত করে চলে যেও না বাবা। তোমরা চলে গেলে আমরা যে অন্ধ হয়ে যাব। কথা শেষ করে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন।
শ্বশুর-শাশুড়ির কাতরোক্তি শুনে ও তাদের চোখে পানি দেখে শিহাব স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে থেকে যান। আর নিজের বাড়িটা ভাড়া দিয়ে দেন।
হিমু গাড়ি নিয়ে যখন শিহাবদের বাসার গেটে পৌঁছাল তখন আটটা বেজে পাঁচ মিনিট। ঝড় কমলেও তখনও অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। গেট বন্ধ দেখে হর্ন বাজাল।
দারোয়ান ছোট গেট খুলে ছাতা খাটিয়ে বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, মাফ করবেন, অপরিচিত কাউকে ভেতরে যেতে দেয়ার অনুমতি আমার নেই। আপনার পরিচয় বলুন।
হিমু সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি ভেতরে গিয়ে বলুন হিমু এসেছেন।
দারোয়ান ছোট গেট বন্ধ করে ভেতরে চলে গেল। একটু পরে ফিরে এসে বড় গেট খুলে দিল।
হিমু গাড়ি ভেতরে নিয়ে এসে করিডোরে পার্ক করল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে একজন দাড়ি-টুপিওয়ালা পৌঢ়কে দেখে সালাম দিল।
রিজিয়া ও হিমুর সব কিছু জানার পর শিহাব শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে আলাপ করার সময় অফিসের ম্যানেজার ফাহিমকে রিজিয়ার জন্য পছন্দ করার কথাও আলাপ করলেন।
আরমান চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ফাহিমকে দেখেছি ও তার সঙ্গে আলাপও করে বুঝেছি, রিজিয়ার উপযুক্ত। কিন্তু হিমু ও রিজিয়ার সম্পর্ক জেনে মনে হচ্ছে, হিমুর সঙ্গে রিজিয়ার বিয়ে দেয়া আমাদের কর্তব্য। তবে তার আগে হিমু কেমন ছেলে তাও আমাদের জানা উচিত।
শিহাব বললেন, আমরাও হিমুকে দেখি নি, তার সঙ্গে আলাপও করি নি। তাই তাকে আসতে বলা হয়েছে।
আরমান চৌধুরী বললেন, আগে আসুক, পরিচয় হোক, তারপর আমার মতামত জানাব।
আরমান চৌধুরী প্রতিদিন এক ঘণ্টা মর্নিংওয়াক করে বাসায় এসে পৌনে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নেন। সেই সময় পেপার পড়ার কাজ সেরে ফেলেন। তারপর পনের মিনিটের মধ্যে গোসল করে কাঁটায় কাঁটায় আটটায় নাস্তা করেন। আজ বৃষ্টির জন্য মর্নিংওয়াক করতে যান নি। কুরআনের তাফসির ও পেপার পড়ে সময় কাটিয়েছেন। তারপর গোসল করে হিমুর জন্য অপেক্ষা করছেন। সে সকাল আটটায় আসবে তাই মেয়ে আরিফা বেগম নির্দিষ্ট সময়ে নাস্তা খেতে ডাকলেও খান নি। বলেছেন, হিমু আসার পর একসঙ্গে খাবেন। তিনি বারান্দায় পায়চারি করছিলেন আর ভাবছিলেন, এই বৃষ্টির মধ্যে হিমু কি আসবে? না বৃষ্টি কমলে বা ছাড়ার পর আসবে? এমন সময় গাড়ির হর্ন শুনে গেটের দিকে তাকিয়ে দারোয়ানের কার্যকলাপ দেখলেন। তারপর তাকে ছাতা মাথায় আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কে এসেছে?
দারোয়ান বলল, হিমু নামে এক যুবক ছেলে।
যাও, তাড়াতাড়ি গেট খুলে দাও।
হিমু গাড়ি থেকে নেমে সালাম দিতে আরমান চৌধুরী উত্তর দিয়ে বললেন, আমি আরমান চৌধুরী, শিহাবের শ্বশুর। তারপরে বললেন ভেতরে চলুন।
হিমু ভেতরে আসার সময় বলল, আপনি আমার দাদুর বয়সী, আমাকে আপনি করে বলে লজ্জা দেবেন না।
আরমান চৌধুরী মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে। তারপর ড্রইংরুমে এসে বসতে বলে নিজেও বসে বললেন, এত বৃষ্টির মধ্যে তুমি আসবে ভাবতে পারি নি। পাঁচ মিনিট লেট হলেও তোমার পাংচুয়েলিটি জ্ঞান আছে জেনে খুশি হয়েছি। প্রতিদিন আটটার সময় আমি নাস্তা খেলেও আজ তোমার সঙ্গে খাব বলে খাই নি। আশা করি, তুমিও নাস্তা না খেয়ে এসেছ?
আরমান চৌধুরীকে দেখেই হিমুর মনে শ্রদ্ধাবোধ জেগেছিল। তারপর তার কথা শুনে আরো বেড়েছে। মৃদু হেসে বলল, এখানে নাস্তা খাব বলে আমিও না খেয়ে এসেছি।
গুড, ভেরি গুড বলে আরমান চৌধুরী হাঁক দিয়ে বললেন, কে কোথায় আছ, মেহমান এসে গেছে নাস্তা নিয়ে এস।
রিজিয়া ও ফারিহা শুধু চোখ দুটো ছাড়া মাথা ও সারা শরীর ঢেকে দুপ্লেট নাস্তা, পানির জগ ও গ্লাস নিয়ে এসে সালাম দিল।
হিমু তাদের দিকে তাকিয়ে সালামের উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই আরমান চৌধুরী উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাদেরকে কি কাজের বুয়া হিসেবে নতুন এপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে?
কথাটা শুনে হিমু লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে নিল।
রিজিয়াও দাদুর কথা শুনে তাই করল।
কিন্তু ফারিহা তা না করে বলল, কেউ আমাদেরকে এপয়েন্টমেন্ট দেয় নি, নিজেরাই নিয়েছি। মেহমানকে কাজের বুয়াকে দিয়ে মেহমানদারি করালে তাকে অপমান করা হয়। আমাদের নবী করিম (সঃ) নিজের হাতে মেহমানের খেদমত করেছেন।
আরমান চৌধুরী আফসোসের স্বরে বললেন, তা হলে তো আমারই করানো উচিত ছিল।
ফারিহা বলল, আপনি মুরুব্বি মানুষ, আমরা থাকতে আপনি করাবেন কেন? আর আমরাইবা আপনাকে করতে দেব কেন? তা ছাড়া উনি আমাদের মেহমান, আমাদেরই তো করান উচিত।