হিমু বলল, তোমার বাবা আমাদের ভালবাসার কথা শুনে রেগে যান নি?
তা বলতে পারব না। তবে মনে হয় রাগেন নি। রাগলে আপনাকে বাসায় নিয়ে আসার কথা বলতেন না।
এটাও তো হতে পারে, অপমান করে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য বাসায় ডেকেছেন।
সম্ভাবনা যে একদম নেই, তা নয়। তবে আমার যতদূর ধারণা, আপনি যা ভাবছেন তা নাও হতে পারে।
তোমার কথা মেনে নিতাম যদি তিনি রিজিয়ার জন্য ছেলে পছন্দ না করতেন।
তা হলে বাসায় আসতে চাচ্ছেন না?
আসব না মানে, ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় আসব। তুমি জান না ফারিহা, রিজিয়া যে আমার হৃদয়ে কিভাবে জড়িয়ে আছে, তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। ওকে পাওয়ার জন্য এমন কোনো কাজ নেই, যা আমি করতে পারব না।
শুনে খুব খুশি হলাম। দোয়া করি আল্লাহ আপনার মনের ইচ্ছা পূরণ করুন।
হিমুর কথা শুনে রিজিয়ার দু’চোখ পানিতে ভরে উঠেছিল। ফারিহা যাতে দেখতে না পায় সেজন্য তাড়াতাড়ি ওড়নায় চোখ মুছে ফেলল।
তার আগেই ফারিহা তার চোখের পানি দেখে ফেলে বলল, তুই বড় ছিচকাঁদুনে মেয়ে। এখন কাঁদার কি হল? নে, এবার চল আর দেরি করা ঠিক হবে না বলে কেউ কিছু বলার আগে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল।
রিজিয়া ভেজা চোখে হিমুর মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার ভালবাসার মূল্য আমি কি দিতে পারব? কেবলই মনে হয়, আল্লাহ যদি আমাদের মিলন তকদিরে না লিখে রাখেন, তা হলে তোমার অবস্থা কি হবে? কথাটা শেষ করে আবার চোখ মুছল।
হিমু বলল, সে কথা তকদির যিনি লিখেছেন তিনি জানেন। প্লিজ রিজিয়া, সবুর কর। তুমি তো আমার থেকে হাদিস-কালাম বেশি জান। তবু এত অধৈর্য হচ্ছে কেন? গত রাতে হাদিসে পড়লাম আমাদের নবী করিম (সঃ) বলেছেন, ধৈর্য ঈমানের অর্ধেক। এ কথা জেনেও সবুর করতে পারছ না কেন?
রিজিয়া সামলে নিয়ে চোখ-মুখ মুছে বলল, হাদিসটা জানলেও সব সময় মনে থাকে না। এবার থেকে ইনশাআল্লাহ মনে রাখার চেষ্টা করব। তারপর বলল, ফারিহা বাইরে অপেক্ষা করছে চল যাই। বেরুবার সময় জিজ্ঞেস করল, বাসায় কবে আসছ তা হলে?
পরশু শুক্রবার সকাল আটটার দিকে আসব।
বাইরে এসে দেখল, ফারিহা একটা স্কুটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরকে দেখে বলল, বিয়ের আগে এতক্ষণ ধরে আলাপ করা উচিত নয়। অবশ্য বিয়ের পর যতক্ষণ ইচ্ছা বলে রিজিয়াকে বড় বড় চোখ বের করে রাগের সাথে তার দিকে তাকাতে দেখে থেমে গেল। তারপর সরি বলে স্কুটারে উঠে হিমুকে জিজ্ঞেস করল, কবে আসছেন ওকে বলেছেন?
হিমু বলল, হ্যাঁ, পরশু সকাল আটটায়।
রিজিয়া হিমুর সঙ্গে সালাম বিনিময় করে স্কুটারে উঠে বলল, আল্লাহ হাফেজ।
হিমুও বলল, আল্লাহ হাফেজ।
.
বাসায় ফিরে হিমু দাদুকে বলল, শিহাব চাচা আমাকে যেতে বলেছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, দাদু তাই।
তা তোমাকে খবরটা দিল কে?
রিজিয়া।
নাতনির নাম শুনে জাহিদ হাসানের চোখে পানি আসার উপক্রম হল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে বললেন, ওকে দেখার জন্য মন ক্রমশ: উতলা হয়ে উঠছে।
আমি তো দেখাতে চেয়েছিলাম, আপনি আজ নয় অন্যদিন বলে এড়িয়ে গেছেন।
জাহিদ হাসান একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, কেন যে এড়িয়ে যাই জানিস?
না বললে জানব কি করে?
ওর সামনে যাওয়ার মুখ আমার নেই।
আমার যত দূর ধারণা, আপনার প্রতি ওর কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই।
কি করে বুঝলি?
আপনি ওকে নাতবৌ করতে রাজি আছেন শুনে খুব খুশি হয়েছে। রাগ বা ক্ষোভ থাকলে কি খুশি হত? পরশুদিন ওদের বাসায় যাব বলেছি, আপনিও চলুন।
শিহাবের কাছেও আমি অপরাধী। সে আমাকে কিভাবে গ্রহণ করবে না জানা পর্যন্ত ওদের বাসায় যাব না। পরশুদিন তুই একা যা, কি কথা হয় না হয় জানার পর ভালো বুঝলে যাব।
.
আজ শুক্রবার। কয়েকদিন খুব গুমোট ছিল। ভোর থেকে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ঝাঁপটা খোলা জানালা দিয়ে হিমুর গায়ে পড়তে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে জানালা বন্ধ করে ঘড়ি দেখল। পাঁচটা বাজে। এতদিন নামায পড়ার জন্য নামায শিক্ষা দেখে বাংলায় কয়েকটা সূরা, নামাযের অন্যান্য সব কিছু মুখস্থ করেছে এবং নামায পড়ার নিয়মকানুন শিখে নিয়ত করেছে, শুক্রবার ফজর থেকে শুরু করবে। সে প্রতিদিন সাতটা পর্যন্ত ঘুমায়। আজ পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে যেতে নামায শুরু করার কথা মনে পড়ল। তাই বাথরুমের কাজ সেরে অযু করে এসে নামায পড়ল। তারপর গতকালের কিনে আনা কুরআনের বঙ্গানুবাদ পড়তে লাগল। সাতটা বাজতে গোসল করে দাদুর কাছে গিয়ে বলল, তুমি কি এ বেলা কোথাও যাবে?
জাহিদ হাসান বললেন, কেন, গাড়ি নিয়ে কোথাও যাবি বুঝি?
হ্যাঁ দাদু।
নিয়ে যা, তবে দুপুরের মধ্যে ফিরবি, আমি বিকেলে একটু বেরুব।
বেরুবার সময় হিমু মায়ের সামনে পড়ে গেল। সাবিহা বেগম বললেন, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে এত সকালে কোথায় যাচ্ছিস? নাস্তা খাবি না?
না মা খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। খুব জরুরি একটা কাজে যাচ্ছি। বাইরে নাস্তা খেয়ে নেব।
.
০৮.
শিহাবের শ্বশুর আরমান চৌধুরী দশ কাঠা জমির পূর্ব পার্শ্বে দু’তলা বাড়ি করেছেন। তিনি খুব শৌখিন মানুষ। প্রতি তলায় তিনটি ফ্লাট। ভাড়া দেয়ার জন্য বাড়ি করেন নি, করেছেন নিজেরা থাকার জন্য। নিজে শৌখিন, তার বাড়িটাও শৌখিন। চারপাশে বারান্দা, দোতলায় ওঠার তিনটে সিঁড়ি। একটা নিচতলার ফ্লাটের ড্রইংরুম থেকে। অন্য দুটো দু’পাশের বারান্দা থেকে। গেটের পূর্ব দিকে ড্রাইভার, দারোয়ান ও কাজের লোকদের জন্য পাকা টিনশেডের তিনটে রুম। গাড়ি রাখার গ্যারেজ নেই। বারান্দার কড়িডোর বেশ বড়। তারই একপাশে গাড়ি থাকে। পুরো বাড়িটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পশ্চিম পাশে ফুলের বাগান। বাকি জায়গাটা ফাঁকা রেখেছেন ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা করার জন্য। যদিও আরিফা বেগম তাঁদের একমাত্র সন্তান। ভবিষ্যতে নাতি-নাতনি খেলাধুলা করবে চিন্তা করে এই ব্যবস্থা।