ঠিক আছে, তাই হবে।
কুতুবউদ্দিন প্রথমে একটা বেড়ার ঘরে স্ত্রী ও চার বছরের ছেলে আব্দুল আযীযকে নিয়ে থাকতেন। ছেলে দশ বছরের হতে আরো একটা বেড়ার ঘর করেন। ছেলের বিয়ে দেয়ার আগে বেড়ার ঘর ভেঙ্গে পাকা ওয়াল ও উপরে টিনের চাল দিয়ে তিন কামরা ঘর করেন। একটা কামরায় তিনি স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। অন্য কামরায় আব্দুল আযীয ও তার স্ত্রী থাকতেন। বাকি কামরাটা বৈঠকখানা।
একদিন স্কুল ছুটির পর আযীয মাস্টার ঘরে আসার পথে মসজিদ থেকে আসরের নামায পড়ে এসে বৈঠকখানায় বসে চা খাচ্ছিলেন। এমন সময় শিহাব রাকিবকে নিয়ে এসে বাইরে থেকে বলল, স্যার বাড়িতে আছেন?
সাবেরা আব্বাকে চা দিতে এসে কাপ নিয়ে যাবে বলে সেখানে দাঁড়িয়েছিল। কেউ আব্বার কাছে এসেছে বুঝতে পেরে বলল, আমি যাই, পরে এসে কাপ নিয়ে যাব। কথা শেষ করে ওড়না দিয়ে নাক পর্যন্ত মুখ ঢেকে বেরিয়ে এসে শিহাবকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, শিহাব ভাই কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে শিহাব বলল, ভালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, স্যার আছেন?
হ্যাঁ আছেন। ভেতরে যান বলে এক পলক রাকিবের দিকে তাকিয়ে সাবেরা চলে গেল।
আযীয মাস্টার তাদের কথা শুনতে পেয়ে বললেন, কে? শিহাব না কি? এস ভেতরে এস।
শিহাব রাকিবকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে আযীয মাস্টার তাদেরকে বসতে বলে বললেন, কি খবর শিহাব?
শিহাব বলল, খবর ভালো, আপনি ভালো আছেন?
হ্যাঁ বাবা, আল্লাহ ভালই রেখেছেন। তা হঠাৎ কি মনে করে এসেছ? তারপর রাকিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে তো চিনতে পারছি না।
রাকিব কিছু বলার আগে শিহাব বলল, ও রাকিব, আমার বন্ধু। ভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়ি। বেড়াতে এসেছে। আমার মুখে আপনার কথা শুনে দেখা করতে এসেছে। তারপর রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই স্যারের সঙ্গে আলাপ কর, আব্বা এই গ্রামের একটা লোকের সঙ্গে দেখা করতে বলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি বলে শিহাব বেরিয়ে গেল।
আযীয মাস্টার রাকিবকে বললেন, শিহাব আমার ছাত্র, তুমি ওর বন্ধু। তোমাকে আমি তুমিই করে বলব, কিছু মনে করবে না তো?
রাকিব বিগলিত কণ্ঠে বলল, এতে মনে করার কি আছে? নিশ্চয়ই তুমি করে বলবেন।
তোমাদের বাড়ি মনে হয় ঢাকাতেই?
জি।
তোমার বাবা কি করেন?
উনি ব্যবসায়ী।
তোমরা কয় ভাইবোন?
শুধু দুই ভাই, বোন নেই। আমি ছোট।
বস, চায়ের কথা বলে আসি বলে আযীয মাস্টার উঠে দাঁড়ালেন।
রাকিব বলল, শিহাবের সঙ্গে চা খেয়ে এসেছি। এখন আর খাব না, আপনি বসুন। একটা কথা বলব বেআদবি নেবেন না স্যার। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।
ঠিক এই সময় সাবেরা একটা বড় থালায় দু’কাপ চা ও কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে আসার সময় রাকিবের কথা শুনে খুব অবাক হয় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর জানালার পাশে এসে ভেতরে তাকিয়ে দেখল, শিহাব ভাই নেই। তার সঙ্গের ছেলেটা রয়েছে। ভাবল, ছেলেটা কে? শিহাব ভাইয়ের সঙ্গে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিল, অথচ শিহাব ভাই নেই। আব্বা কি বলে শোনার জন্য রাকিবের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
হোয়াট বলে আযীয মাস্টার কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার মেয়েকে চেনো?
কথাটা বলে রাকিব লজ্জায় মুখ নিচু করে নিয়েছিল। এবার মুখ তুলে বলল, জি না। তবে শিহাবের সঙ্গে কাল বেড়াতে বেরিয়ে এখান থেকে যাওয়ার সময় এক নজর দেখেছি।
আযীয মাস্টার অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার বয়স কম। তাই যে কথা বললে তার গুরুত্ব বোঝ না। শিহাবের বন্ধু, তাই কিছু বললাম না। অন্য কোনো ছেলে এ রকম কথা বললে চাবকে পিঠের ছাল তুলে বের করে দিতাম।
রাকিব রাগল না। মোলায়েম স্বরে বলল, আমার বয়স কম হলেও খুব একটা কম নয়। ভার্সিটিতে পড়ছি, জ্ঞানও যে একদম হয় নি তা নয়। জীবনসঙ্গী পছন্দ করার মতো বয়স ও জ্ঞান হয়েছে। আর কথাটার গুরুত্ব বোঝার মতো জ্ঞানও আমার হয়েছে। আপনি বাবার বয়সী ও একজন শিক্ষক। চাবকে আমার পিঠের ছাল তুলে বের করে দিলেও কিছু মনে করতাম না। ফিরে এসে ঐ কথা আবার বলতাম।
আযীয মাস্টার চিন্তা করলেন, অন্য কোনো ছেলে হলে তার কথা শুনে রেগে যেত ও অপমান বোধ করে চলে যেত। কিন্তু তা না করে যা বলল, তাতে মনে হল ছেলেটার চরিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম?
জি, রাকিব হাসান।
বাবার নাম?
জাহিদ হাসান।
আযীয মাস্টার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি এখন যাও। শিহাবের ফিরতে বোধ হয় দেরি হবে। ওকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।
রাকিব চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে সালাম দিতে যাবে, এমন সময় সাবেরা ঘরে ঢুকে আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বলল, শিহাব ভাই কোথায়?
আযীয মাস্টার মেয়েকে চা-বিস্কুট নিয়ে আসতে দেখে তার কথার উত্তর দিয়ে রাকিবকে বললেন, বস, চা খেয়ে যাবে।
সাবেরা থালাটা টেবিলের উপর রেখে চলে গেল।
চা খেয়ে রাকিব সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে বেরিয়ে কিছু দূর আসার পর শিহাবকে একটা গাছতলায় বসে থাকতে দেখে বলল, কি রে, এখানে বসে রয়েছিস যে? কার সঙ্গে দেখা করতে যাবি বললি, গিয়েছিলি?
শিহাব হেসে উঠে বলল, তোকে স্যারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য ঐ কথা বলে চলে এসেছি। চল এবার ঘরে যাই। তারপর যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, স্যারকে কথাটা বলেছিস?