হিমু বলল, এত ভয় পাচ্ছ কেন? সুখবরটা শুনলেই পথটার কথা জানতে পারবে। সুখবরটা পরে বলছি, তার আগে যে কথা বলব শুনে চমকে উঠবে। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমার বাবার নাম রাকিব হাসান, তাই না?
রিজিয়া খুব অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ, কিন্তু তুমি জানলে কি করে? তোমাকেতো বাবার নাম বলি নি।
এমন সময় বেয়ারা নাস্তা নিয়ে এলে হিমু বলল, আগে নাস্তা খেয়ে নিই এসো তারপর বলব।
নাস্তার আইটেম দেখে ফারিহা বলল, আমরা তো কেউ অর্ডার দিই নি, তবু এসব দিল কেন?
হিমু বলল, আমি প্রায় সময় এখানে নাস্তা খাই। এখানকার সবাই আমাকে চেনে এবং কি কি খেতে পছন্দ করি তাও জানে। তা ছাড়া রিজিয়াকে নিয়ে কয়েকবার এখানে নাস্তা খেতে এসেছি। তাই এখানে এলে অর্ডার দিতে হয় না। এসব আইটেম কি তোমার পছন্দ নয়?
ফারিহা বলল, না-না, তা নয়। বরং এগুলো আমিও পছন্দ করি।
তা হলে শুরু করা যাক বলে হিমু খেতে শুরু করল।
খাওয়ার পর রিজিয়া হিমুকে বলল, বাবার নাম জানলে কি করে বল।
হিমু বলল, শুধু নামই নয়, বাড়ি ঢাকায়, বড় বিজনেস ম্যানের ছেলে। তোমার মায়ের নাম সাবেরা তাও জানি। আরো জানি, রাকিব হাসান বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে তোমার মাকে দেখে মুগ্ধ হন এবং মা-বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে করেন। বিয়ের ছ’মাসের মধ্যে কানাডায় রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা যান। তোমার বয়স যখন দু’বছর তখন তোমার মাও মারা যান। আরো অনেক কিছু জানি। সেসব শোনার দরকার আছে বলে মনে করি না।
হিমুর কথা শুনে রিজিয়া এত অবাক হল যে, বেশ কিছুক্ষণ স্ট্যাচুর মত বসে রইল।
ফারিহা এসব কথা বাবার কাছে কিছু কিছু শুনলেও রিজিয়ার কাছে সব কিছু শুনেছে। কিন্তু উনি কি করে এসব কথা জানলেন ভেবে সেও খুব অবাক হল।
তাদের অবস্থা দেখে হিমু মৃদু হেসে বলল, আমার কথা শুনে তোমরা যতটা অবাক হয়েছ, এবার যা বলব, শুনে আরো বেশি অবাক হবে। তারপর রিজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার বাবা রাকিব হাসান আমার আপন ছোট চাচা। আর তুমি হলে আপন চাচাত বোন।
ফারিহা শুনে চমকে উঠে মূক ও বধির হয়ে গেল।
আর রিজিয়া চমকে উঠলেও আনন্দ ও বেদনায় তার চোখ দিয়ে পানি গড়ে পড়তে লাগল।
এক সময় ফারিহা বলে উঠল, তা হলে আপনি সব কিছু জেনেই রিজিয়াকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
হিমু বলল, কথাটা ঠিক না হলেও একেবারে অস্বীকার করতে পারব না। দু’বছরের রিজিয়াকে যখন তার নানা দাদা-দাদির কাছে দিতে এসেছিলেন তখন আমার বয়স আট-নয় বছর হবে। তাদেরকে অপমান করে তাড়িয়ে দিতে আমি খুব দুঃখ অনুভব করি। পুরো ঘটনাটা শুনে আমার মনে দাগ কাটে এবং আজও ছবির মতো মনে আছে। বড় হওয়ার পর একদিন দাদাজীকে জিজ্ঞেস করে সব কিছু জেনে নিই। তারপর চাচার মতো আমিও এক বন্ধুর সঙ্গে তাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে রিজিয়াকে দেখে মুগ্ধ হই এবং বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই। তাই বন্ধুর কাছে রিজিয়ার সব কিছু জানার চেষ্টা করি। সে অনেক কিছু বলতে পারলেও সবটা পারল না। তখন তার বাবার কাছ থেকে জেনে নিই এবং সিদ্ধান্তটা দৃঢ় করি। তারপর বন্ধুর সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণ, ডাক্তারি পাস করার পর রিজিয়াদের গ্রামে যাওয়ার কথা ও ঢাকায় ফিরে রিজিয়াকে খোঁজাখুঁজির কথা বলল।
রিজিয়া সামলে নিয়ে চোখ মুছে হিমুর কথা শুনছিল। সে থেমে যেতে বলল, এবার সুখবরটা বল।
হিমু আবার বলতে শুরু করল, আড়ং-এ তোমাকে দেখার পর দাদাজীকে তোমাকে পছন্দ করার কথা জানাই। তিনি আমাকে ভীষণ ভালবাসেন। তাই তোমাকে দেখতে চাইলেন। আমি বললাম, নিশ্চয় দেখাব। তারপর গতকাল যখন তোমার পরিচয়, মা-বাবার অমতের কথা ও আমার সিদ্ধান্তের কথা বললাম তখন অভয় দিয়ে বললেন, তুই কোনো চিন্তা করিস না, আমি যেমন করে তোক রিজিয়াকে নাতবৌ করে ঘরে আনবই। তারপর ছলছল চোখে বললেন, দু’বছরের রিজিয়াকে সেদিন আভিজাত্যের অহঙ্কারে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম বটে, কিন্তু সেই থেকে বিবেকের কষাঘাতে আজও আমি জর্জরিত। আরো বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা কর। তাই বলছি, দাদাজী যখন আমাদের পক্ষে তখন আর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এখন বল, কোথায় তোমার ও দাদাজীর সাক্ষাৎ হতে পারে?
রিজিয়া বলার আগে ফারিহা বলল কেন? আমাদের বাসায় দাদাজীকে নিয়ে আসুন অথবা রিজিয়াকে আপনাদের বাসায় নিয়ে যান।
হিমু বলল, মা রিজিয়াকে দেখেছে, চিনে ফেলবে।
তা হলে আমাদের বাসায় নিয়ে আসুন। রিজিয়াকে দেখাও হবে আর সেই সাথে বাবার কাছে প্রস্তাবও দেবেন।
কথাটা মন্দ বল নি। দাদুর সঙ্গে আলাপ করে দেখি উনি কি বলেন।
এবার রিজিয়া বলল, মনে হয় দাদু আমাদের বাসায় যাবেন না। কারণ শিহাব মামা আব্দুর বন্ধু ছিলেন। তাকে দাদু চেনে। ছোটবেলায় যখন নানাজী আমাকে দিতে এসেছিলেন তখন শিহাব মামাও সঙ্গে ছিলেন এবং তিনিই আব্বার বিয়ের ঘটনা বলে আমাকে গ্রহণ করতে বলেছিলেন। সেদিন তাকেও দাদু যা তা বলে অপমান করেছিলেন।
হিমু বলল, তোমার ধারণা ঠিক। ছেলের বন্ধু জেনেও যাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার বাসায় যাবেনইবা কি করে? আর বিয়ের প্রস্তাবই বা দেবেন কি করে?
ফারিহা বলল, শুধু দেখতে চাইলে একদিন দাদুকে এখানে নিয়ে আসুন, রিজিয়াকেও সেই সময় আসতে বলবেন।