এমন সময় সাবিহা বেগম সেখানে এসে শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, নাতির সঙ্গে সেই কখন থেকে কি এত গল্প করছেন? এদিকে ক’টা বাজে খেয়াল করেছেন? দেড়টা বাজে, গোসল করবেন কখন আর খাবেনই বা কখন? কতবার বলেছি, এই বয়সে সময়মতো সব কিছু না করলে অসুখ করবে। তারপর ছেলেকে বললেন, তুই ডাক্তার হয়েছিস, না গাধা হয়েছিস? দাদুর সব কিছুর দিকে লক্ষ্য রাখবি না?
জাহিদ হাসান বললেন, ওকে শুধু শুধু বকছ কেন বৌমা? ঐ তো আমার সব কিছুর দিকে লক্ষ্য রাখে। এখন ওর সঙ্গে একটা জরুরি ব্যাপারে আলাপ করছিলাম। তাই একটু দেরি হয়ে গেছে। তুমি যাও, আমরা এক্ষুনি গোসল করে খেতে আসছি।
রিজিয়ার কাছ থেকে হিমু জেনেছে, শিহাব চাচা দুপুরে খেতে এলেও তিনটের আগে আবার অফিসে যান। আর তার মামি স্বামী অফিসে চলে যাওয়ার পর বিশ্রাম নেন। ফারিহার ছোট বোন ও ভাই পাঁচটা পর্যন্ত স্কুলে থাকে। ফারিহা ও রিজিয়া সেই সময় পড়াশোনা করে। তবে ফারিহা বেশিরভাগ দিন ঘুমায়। সোয়া তিনটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে রিজিয়া তাকে ফোন করার কথা বলেছে। কয়েকদিন আগে রিজিয়া তাকে নিয়ে বায়তুল মোকাররমে গিয়েছিল। তখন মিলাদুননবী উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মসজিদের দক্ষিণ দিকের গেটের বাইরের চাতালে এক মাসব্যাপী ধর্মীয় বই-এর মেলার ব্যবস্থা করেছে। রিজিয়া তাকে নিয়ে বিভিন্ন স্টল ঘুরে কয়েকটা ইসলামিক বই কিনে দিয়েছিল।
আজ খেয়ে উঠে ভাবল, সাড়ে তিনটেয় রিজিয়াকে ফোন করবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আড়াইটা বেজেছে দেখে ঘুমাল না। রিজিয়ার কিনে দেয়া বইগুলো থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ইমাম বুখারী (রঃ) এর ‘আল আদাবুল মুফরাদ’ বইটির বঙ্গানুবাদ ‘অন্যন্য শিষ্টাচার’ বইটি নিয়ে পড়তে লাগল। যতই পড়তে লাগল ততই ইসলামের দেয়া বিধানসমূহ জেনে হতবাক হতে লাগল। ভাবল, ইসলাম পিতা-মাতা, স্ত্রী-পরিজন, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবী, এতিম-মিসকিন, দাস-দাসি, এমন কি মুশরিক আত্মীয় ও সৎ-অসৎ নির্বিশেষে সকলের প্রতি সদয় ব্যবহার করার যে নির্দেশ দিয়েছে, তা কয়জন মুসলমান জানে আর কয়জন মুসলমান মেনে চলে? পড়তে পড়তে কখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে তিনটে পার হয়ে গেছে খেয়াল ছিল না। হঠাৎ খেয়াল হতে ঘড়ি দেখল, প্রায় চারটে বাজে। বইটা রেখে রিজিয়াকে ফোন করল।
ফারিহা ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, কে বলছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে হিমু বলল, আমি হিমু। আপনি কে?
আমি ফারিহা। কেমন আছেন?
ভালো। আপনি কেমন আছেন?
আমি ভালো, তবে রিজিয়া ভালো নেই।
সিরিয়াস কিছু?
না, তেমন কিছু নয়। তবে…
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে হিমু বলল, ও বুঝেছি। দু’দিন ফোন করিনি, তাই মনে হয় খুব রেগে আছে।
তা আমি বলব কি করে? কেন ভালো নেই তাকেই জিজ্ঞেস করুন।
ওকে দিন তো।
দেব কি করে, ওতো নেই।
নেই মানে?
নেই মানে নেই?
প্লিজ, দুষ্টুমি না করে কোথায় গেছে বলুন।
প্রায় এক ঘণ্টা আপনার ফোনের অপেক্ষায় থেকে একটু আগে বাথরুমে গেছে। কথা শেষ করে ফারিহা হেসে উঠল। তারপর বলল, জানেন ও খুব সেলফিস। অভিসারে যাওয়ার সময় কতবার বলি, আমাকেও নিয়ে চল না তোর হিমু সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিবি। প্রতিবারেই বলে, পরেরবারে নিয়ে যাব, কিন্তু একবারও নিয়ে যায় না। আচ্ছা আপনিই বলুন তো, আমি কি ওর কাছ থেকে আপনাকে কেড়ে নেব?
এটা রিজিয়ার উচিত হয় নি। ঠিক আছে, আমি ওকে এক্ষুনি বলে দিচ্ছি, কালই যেন আপনাকে নিয়ে আসে।
দেখা যাক ও আপনার কথা রাখে কি না।
এমন সময় রিজিয়া বাথরুম থেকে এসে ফারিহাকে জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে কথা বলছিস?
তোর হিমু সাহেবের সঙ্গে বলে ফারিহা তার হাতে রিসিভার ধরিয়ে দিল।
রিজিয়া সালাম বিনিময় করে অভিমানভরা কণ্ঠে বলল, দু’দিন ফোন কর নি কেন?
হিমু বলল, ফোন না করে দেখলাম, তুমি কতটা অভিমান করতে পার।
তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে প্রতিদিন ফোন করবে?
কথাটা মনে ছিল না। এবার থেকে মনে রাখার চেষ্টা করব। এই একটা সুখবর আছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, তাই।
তা হলে তাড়াতাড়ি বল।
এখন আর অভিমান নেই তো?
একটু একটু আছে, সুখবরটা শোনার পর একেবারেই থাকবে না।
কিন্তু সুখবরটা ফোনে বলা যাবে না যে!
কেন?
সুখবরের আগে দুঃখের খবর আছে। সেটা না শুনলে সুখবরের গুরুত্ব বুঝতে পারবে না। তাই সামনা-সামনি বলতে চাই।
এখন না হয় আগে দুঃখের খবরটা বলে তারপর সুখবরটা বলবে।
সেসব অনেক কথা। অত কথা ফোনে বলা যাবে না। তাই তো সামনা সামনি বলার কথা বললাম। এক কাজ কর, এক্ষুনি ফারিহাকে নিয়ে গুলশানের ঐ চায়নিজ রেস্টুরেন্টে চলে এস, আমি অপেক্ষা করব। আর একটা কথা, ফারিহা তোমার সঙ্গে আসতে চাইলে তুমি নাকি প্রতিবারেই বল, পরেরবারে নিয়ে আসার কথা?
রিজিয়া হেসে উঠে বলল, ফারিহা বুঝি তোমাকে তাই বলেছে?
হ্যাঁ, একটু আগে তাই তো বলল।
রিজিয়া হাসতে হাসতে বলল, ও না ভীষণ ফাজিল। আমিই বরং ওকে প্রতিবারে যাওয়ার জন্য বলি। ও তখন বলে, আমি সঙ্গে থাকলে তোদের ডিস্টার্ব হবে। তাই কোনো অভিসারিণীর সঙ্গী হতে চাই না। হিমু সাহেব যখন তোর বর হবে তখন চুটিয়ে আলাপ করব।
ফারিহা ঝট করে রিজিয়ার হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে বলল, হিমু সাহেব, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না, ও মিথ্যে বলতে ওস্তাদ।