- বইয়ের নামঃ জোনাকির আলো
- লেখকের নামঃ কাসেম বিন আবুবাকার
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-২. প্রতিদিন ফজরের নামায
জোনাকির আলো – ইসলামিক প্রেমের উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
আযীয মাস্টার প্রতিদিন ফজরের নামায পড়ে প্রায় আধঘণ্টা কুরআন তেলাওয়াত করেন, তারপর এশাকের নামায পড়ে ঘরে এসে বিস্কুট বা মুড়ি খেয়ে চা খান। আজ মসজিদ থেকে ঘরে এসে নাতনিকে দেখতে না পেয়ে একটু উঁচু গলায় বললেন, কোথায় গেলিরে দাদু, চা দিবি না?
রিজিয়া রান্নাঘর থেকে বলল, একটু বসুন, এক্ষুনি দিচ্ছি। দু’তিন মিনিট পর রিজিয়া চা-মুড়ি নিয়ে এসে বলল, বিস্কুট নেই, টিনে এই ক’টা মুড়ি ছিল।
আযীয মাস্টার বললেন, তোর চা কই?
রিজিয়া কিছু না বলে চুপ করে রইল।
আযীয মাস্টার জানেন, যেদিন চা বা চিনি কম থাকে সেদিন তার জন্য শুধু রিজিয়া এক কাপ চা করে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, যা কাপ নিয়ে আয়, একেই দুজনে ভাগ করে খাব।
রিজিয়া বলল, আপনি খেয়ে নিন নানা, আমি আজ চা খাব না।
ওসব নেই কাল বললি না কেন? কিনে নিয়ে আসতাম।
আপনার কাছে তো টাকা নেই, কিনে আনতেন কি করে? কথাটা রিজিয়া বলতে গিয়েও বলল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বস। মুড়ি খা।
না নানা আপনি খান। আমি মুড়ি খাব না। পান্তা আছে খাব। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে রিজিয়া বলল, যা চাল আছে এ বেলা হবে, ওবেলার চাল নেই।
তোর সামসু মামার দোকান থেকে দু’কেজি নিয়ে আসিস। বলবি নানা টাকাটা পরে দেবে।
চিনি কম আছে দেখে আপনার কথা বলে একশো গ্রাম আনতে গিয়েছিলাম, দিল না। বলল, তোর নানার কাছে অনেক টাকা পাব, এখন আর বাকি দিতে পারব না।
ততক্ষণে আযীয মাস্টারের চা-খাওয়া হয়ে গেছে। বললেন, মাতব্বরের কাছে যাই, কিছু টাকা হাওলাত নিয়ে আসি।
তার কাছ থেকে তো অনেক টাকা হাওলাত নিয়েছেন, এখন আর দেবেন বলে মনে হয় না।
দেবে দেবে, না দিলে আমরা যে উপোস করে দিন কাটাব তা মাতব্বর জানে।
কিন্তু আর কত দেবেন? তিনি তো অনেক দিয়েছেন।
অনেক দিলেও আরো দেবে।
কিন্তু কেন তিনি আপনাকে টাকা দিচ্ছেন? আপনি কি তা হলে বাস্তুভিটেও তাকে লিখে দিয়েছেন?
এখনো দিই নি, তবে এবার হয়তো দিতে হবে।
আপনাকে কতবার মাতব্বরের কাছ থেকে টাকা হাওলাত নিতে নিষেধ করেছি,তবু নেন কেন?
কি করব রে দাদু, সে ছাড়া অন্য কেউ তো একটা পয়সাও দিতে চায়। মাতব্বর দেয় বলে তবু খেতে পাচ্ছি, না দিলে কি হত আল্লাহ জানে।
মাতব্বর তো এমনিই দেন না, বাস্তুভিটের লোভে দেন।
তোর কথা হয় তো ঠিক; কিন্তু অন্য কেউ সেই লোভেও দিতে রাজি হয় নি।
এই ভিটে নিতে অন্য কেউ কেন রাজি হয় নি রিজিয়া জানে। নানার কাছে শুনেছে, তাদের বাস্তুভিটেটা অনেক আগে হিন্দুদের মড়াচির ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় ইংরেজরা যখন চলে যায় তখন হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান নামে ভারতকে দুটো অংশে ভাগ করে দেয়। সেই সময় পাশের গ্রামে যে কয়েক ঘর হিন্দু ছিল, তারা সব কিছু বিক্রি করে হিন্দুস্তানে চলে যায়। সেই থেকে এই মড়াচির এমনি পড়ে ছিল। এখানে নাকি গভীর রাতে নানা রঙের আলো দেখা যেত, মেয়েদের কান্নাও শুনতে পেত। তাই ভয়ে এদিকে কেউ বড় একটা আসত না। একদিন সকালে গ্রামের লোকজন দেখল, মড়াচিরে একটা নতুন বেড়ার ঘর। তারা অবাক হলেও কে এই ঘর বানাল জানার জন্য কেউ সাহস করে সেখানে যেতে পারল না। কয়েকদিন পর জোহরের নামায পড়ার সময় মসজিদে একজন অচেনা দাড়িওয়ালা লম্বা চওড়া লোককে দেখে মুরুব্বিদের একজন তার পরিচয় জানতে চাইলেন। লোকটি বললেন, আমার নাম কুতুবউদ্দিন। আমাদের ঘর-বাড়ি, জমি জায়গা…নদীতে বিলীন হয়ে গেছে, তাই আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে আপনাদের পাশের গ্রামে আসি। সেখানে অনেকের কাছে থাকার জন্য একটু জমি চাইতে তাদের একজন এই জায়গাটার কথা বলে বললেন, ওটা হিন্দুদের জায়গা। তারা দেশ ভাগ হওয়ার সময় ভারতে চলে গেছে। বর্তমানে ওটার কেউ ওয়ারিস নেই। আপনি ওখানে ঘর করে থাকতে পারেন। তাই ওখানে একটা ঘর তৈরি করে এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকছি।
মুরুব্বি লোকটি বললেন, কিন্তু জায়গাটায় যে হিন্দুরা মড়া পুড়াত। সে কথা বলে নি?
কুতুবউদ্দিন বললেন, না বলে নি।
এই কয়েকদিনে কিছু অসুবিধে হয় নি?
কই না তো? তবে পানির জন্য একটু অসুবিধে হচ্ছে। পাশের গ্রামের যে বড় পুকুর রয়েছে, ওখান থেকে পানি নিয়ে আসতে হয়। ভাবছি, এখানে একটা পুকুর কাটাব।
মুরুব্বিরা তার কথা শুনে ভাবলেন, লোকটার বেশ টাকা-পয়সা আছে। ওখানে থাকলে তাদের তো কোনো অসুবিধে নেই। তা ছাড়া যে লোক স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে মাড়াচিরে থাকতে পারে, সে লোক নিশ্চয় সাধারণ লোক নয়। তাই তারা আর কিছু বললেন না।
জায়গাটা পাশাপাশি দু’টো গ্রামের মাঝখানে ও শেষ প্রান্তে জনবসতি থেকে একটু দূরে। তাই কুতুবউদ্দিন সেখানে বাস করলেও দুটো গ্রামেরই লোকজন তার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখে নি। তবে কুতুবউদ্দিন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি পুকুর কাটিয়েছিলেন। পুকুরের চারদিকের পাড়ে আম, জাম, নারিকেল, পেয়ারা ও অন্যান্য ফলের গাছ লাগিয়েছিলেন। সে সব গাছে এখন ফল হচ্ছে। কিছু জমি-জায়গাও কিনেছিলেন। তারই ছেলে আযীয মাস্টার। আযীয মাস্টার এস.এস.সি. পাস করে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করতেন, আর বাবার সঙ্গে চাষবাসের কাজ করতেন। সবাই তাকে আযীয মাস্টার বলে ডাকে। কুতুবউদ্দিন ছেলের বিয়ে দেয়ার তিন বছর পর মারা যান। আযীয মাস্টারের একমাত্র মেয়ে সাবেরা অত্যন্ত সুন্দরী ছিল। সে ক্লাস ফাঁইভ থেকে বোরখা পরে এস.এস.সি. পর্যন্ত লেখাপড়া করে। কলেজ অনেক দূর বলে মেয়েকে আর পড়ান নি। তবে প্রচুর ধর্মীয় বই কিনে দিয়েছেন। সাবেরা সে সব পড়ে ধর্মের সব কিছু নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করত। পাশের গ্রামের ধনী আকরাম চৌধুরীর ছেলে শিহাব ঢাকায় ভার্সিটিতে পড়ত। ক্লাসমেট রাকিবের সঙ্গে শিহাবের গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। রাকিব একবার শিহাবের সঙ্গে তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। একদিন বেড়াতে বেরিয়ে আযীয মাস্টারের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সাবেরাকে দেখে এত মুগ্ধ হল যে, তাকে বিয়ে করার সংকল্প করে। এক সময় বন্ধু শিহাবকে কথাটা জানাতে সে হেসে উঠে বলল, কি যা তা বলছিস? তুই এখন ছাত্র। তা ছাড়া তোর বাবা ধনী ব্যবসায়ী। তিনি ও তোর মা কিছুতেই রাজি হবেন না।