লাইন কেটে দিয়ে রাহেলা বলল, বাবার আসতে একঘন্টা দেরি হবে। চল, ততক্ষণ আমরা সাঁতার কেটে গোসল করে আসি।
দু’জনেই দক্ষ সাঁতারু। ডালিয়া ঢাকায় সুইমিং পুলে সাঁতার শিখে সেখানেই প্রতিদিন একঘন্টা সাঁতার কাটে। আর রাহেলা ছোটবেলা থেকে তাদের দীঘিসম বড় পুকুরে প্রতিদিন সাঁতার কেটে গোসল করে। যখনই ডালিয়া মামা বাড়িতে আসে তখনই দুই মামাত ফুপাত বোন বাজি ধরে সাঁতার কাটে। কখন ডালিয়া জিতে আবার কখন রাহেলা জিতে।
সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের দাদা এই পুকুরটা কাটিয়েছিলেন গরমের সময় গ্রামের লোকজনের খাওয়ার পানির কষ্ট লাঘবের জন্য। এখন প্রতিটি পাড়ায় টিউবওয়েল হয়ে গেছে। তাই এখন আর কেউ খাওয়ার পানি নিতে আসে না। তবে গরমের সময় যখন পুকুর ডোবা শুকিয়ে যায় তখন সবাই গোসল করতে আসে। পুকুরটা খুব বড় বলে লোকজন দীঘি বলে। এখন চেয়ারম্যান এই পুকুরে মাছের চাষ করেন।
গোসল করতে এসে পুকুরে নামার সময় রাহেলা বলল, আজ বেশিক্ষণ সাঁতার কাটব না, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। বাবার সঙ্গে পরামর্শ করা লাগবে।
চেয়ারম্যান মেয়েকে একঘন্টার মধ্যে ফিরবেন বললেও ফিরলেন প্রায় দু’আড়াই ঘন্টা পর। খাওয়া দাওয়া করতে করতে তিনটে বেজে গেল। তারপর কাজের বুয়াকে দিয়ে মেয়েকে ডেকে পাঠালেন।
রাহেলা ও ডালিয়া খেয়ে উঠে গল্প করছিল। বুয়ার মুখে বাবা ডাকছে শুনে রাহেলা ডালিয়াকে বলল, তুই ঘুমো আমি আসছি। তারপর বাবার রুমে এসে বলল, এই বুঝি তোমার এক ঘন্টা?
চেয়ারম্যান বললেন, একটা কাজে গিয়েছিলাম। কাজটা শেষ না করে ফিরি কী করে? কী জন্যে জরুরী তলব করেছিলি বল।
রাহেলা বলল, চরদৌলতখান গ্রামের শফি নামে যে ছেলেটা সকালে মারামারির ঘটনা ঘটিয়ে তোমার মান সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিল, তাকে নির্বিঘ্নে চলে যেতে দিলে কেন? শুনে তো আমি বিশ্বাস করতেই পারি নি। তারপর একটা মোবাইল সেট দেখিয়ে বলল, মারামারি করার সময় তার পকেট থেকে এটা পড়ে গিয়েছিল। ডালিয়া কুড়িয়ে এনেছে। দুপুরের দিকে ছেলেটা ফোন করেছিল, বলেছি, বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে এসে নিয়ে যেতে। আসবে বলেছে। আমি চাই, এই সময়ের মধ্যে মোবারক চাচাকে খবর দিয়ে আনিয়ে ওর হাত পা ভেঙ্গে লুলো করে দিতে।
সালাউদ্দিন চেয়ারম্যান মেয়ের মুখের দিকে অল্পক্ষণ চেয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, তুই আমারই মেয়ে, এরকম কথা তোর কাছে আশা করেছিলাম। কিন্তু মা, সবকিছু ভেবেচিন্তে করতে হয়। তাড়াহুড়ো করে করলে ফল ভালো হয় না। তা ছাড়া চেয়ারম্যান হয়ে তৎক্ষণাৎ যদি কিছু করতাম, তা হলে লোকজনের কাছে কী জবাব দিতাম। আমি তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। অপমানের জ্বালা তোর চেয়ে আমার অনেক বেশি। সেই জ্বালা মেটাবার জন্য তোর মোবারক চাচাকে ডাকিয়ে বলেছি, মাস খানেক পরে সুযোগ সুবিধে মতো ভিন গায়ে কাজটা করতে। যাতে করে কেউ যেন আমাদেরকে সন্দেহ করতে না পারে। আজ এলে আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিবি। তা হলে এক মাস পরে কিছু ঘটলে আমরা করেছি কেউ ভাবতে পারবে না। তুই তাকে আপ্যায়ন করলে আমাদেরকে সন্দেহ না করার আরও একটা পয়েন্ট বাড়বে। সঙ্গে ডালিয়াকেও নিতে পারিস। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর সে তার সম্পর্কে অনেক কথা আমাকে জিজ্ঞেস করেছে।
তাই নাকী বলে রাহেলা জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা দেখতে কেমন?
এলেই দেখবি।
তাতো দেখবই।, আগে থেকে জানা থাকলে দোষ কী?
ছ’ফুটের উপর লম্বা, মানানসই স্বাস্থ্য, রং ফরসা, সহজ সরল সুন্দর ছেলে। দেখলে বোঝাই যায় না, সে একজন শক্তিমান ও মারামারীতে ওস্তাদ।
পাশের গ্রামেই তো বাড়ি, তুমি ওদের বাপ-দাদাদের চেনো নিশ্চয়?
তা চিনব না কেন? ওদের বংশের সবাইকেই চিনি। তবে ঐ ছেলেটাকে চিনতাম না। দশ বার বছর বয়সে হারিয়ে গিয়েছিল। আঠার বিশ বছর পর কিছুদিন আগে ফিরে এসেছে।
ওমা, তাই নাকী? তা ওকে চিনলে কীভাবে?
কীভাবে শফিকে চিনলেন, সে কথা চেয়ারম্যান বললেন।
রাহেলা জিজ্ঞেস করল, আপ্যায়ন করার সময় তুমি থাকবে তো?
না, থাকতে পারব না। পাশের গ্রামে মিটিং আছে যেতে হবে। তা ছাড়া আমার না থাকাটাই ভলো মনে করি। এবার যা, একটু গড়িয়ে নিয়ে বেরোব।
রাহেলার মুখে প্রতিশোধ নেয়ার কথা শোনার পর থেকে ডালিয়া বেশ আতংকিত হয়ে রয়েছে। এত সুন্দর ছেলেটার হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দেবে ভেবে শফির প্রতি ভীষণ মায়া অনুভব করছে। তাই রাহেলা তাকে। ঘুমাতে বলে যখন তার বাবার কাছে চলে গেল তখন মামা কী করবেন না করবেন চিন্তা করে ঘুমাতে পারল না। বিছানায় শুয়ে থাকা অসহ্য মনে হতে একটু পরে মামার রুমের দরজার আড়ালে এসে বাপ বেটির কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল। ভাবল, আজ তা হলে শফির কোনো বিপদ হবে না। আরও ভাবল, মোবারক চাচা কে? তার ঠিকানাই বা কোথায়? কত শক্তিমান লোক সে? যে নাকী মেরে শফির হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দেবে। মামা রাহেলাকে চলে যেতে বলায় দ্রুত ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে ঘুমের ভান করে রইল।
রাহেলা ফিরে এসে বলল, কী রে ডালিয়া, ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকী?
ডালিয়া বলল, না ঘুমাইনি, এমনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি।
তারপর সবকিছু জেনেও না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করল, মামা কী বললেন?