সাড়ে ছ’ফুট লম্বা সুন্দর সৌম্য চেহারা ও সু-স্বাস্ত্যের অধিকারী শফির দিকে চেয়ে এতক্ষণ সবাই অবাক হয়ে তার কথা শুনছিল। চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন শফিকে চিনতে পেরেছেন। ছেলে মহসিন ও তার পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে তার লড়াই দেখে খুব অবাক হয়েছেন। লড়াই শেষে তার কথা শুনে মনে মনে তারিফ না করে পারলেন না। তাকে চলে যেতে দেখে বললেন, এই ছেলে দাঁড়াও।
শফি কথা বলার সময় চেয়ারম্যানকে দেখে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করেছিল। এখন ওনার গলা শুনে থমকে ঘুরে দাঁড়াল।
চেয়ারম্যান বললেন, আমার কাছে এস।
শফি কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, বলুন, কী বলবেন।
কয়েকদিন আগে পথে রবিউলের সঙ্গে তোমাকে দেখেছিলাম। তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তোমাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলেছিলাম মনে আছে?
জি, আছে।
মনে হয় এখানে কারও বাড়িতে এসেছিলে, অথচ আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে যাচ্ছিলে কেন?
এখানে কারও বাড়িতে আসিনি। নলছটিতে নানার বাড়ি চার-পাঁচ দিন আগে গিয়েছিলাম। আজ ফিরছিলাম। এখানে আপনার বাড়ি জানলে নিশ্চয় দেখা করতম।
এখন চল না, কিছু নাস্তা পানি করে যাবে।
শুকরিয়া। ধৃষ্টতা মাফ করবেন, আজ নয়, অন্য একদিন এসে নাস্তাপানি করব। এবার যাবার অনুমতি দিন।
ঠিক আছে, যাও। একদিন এস কেমন?
জি আসব বলে শফি সালাম বিনিময় করে হাঁটতে শুরু করল।
শফির চলে যাওয়ার দিকে সবাই চেয়ে রইল। রাস্তার বাঁকে আড়াল হয়ে যাবার পর চেয়ারম্যান একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ছেলে ও তার বন্ধুদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ঐ ছেলেটার কথাই ঠিক, তোমরা লেখাপড়া করে মানুষ না হয়ে গুডা হয়েছ। তাও ভালো গুণ্ডা হতে পার নি। তা না হলে একটা নিরস্ত্র ছেলে স্বসস্ত্র ছয়জনকে মেরে হাত পা ভেঙ্গে দিয়ে বিজয়ীর বেশে চলে গেল কী করে? শুধু তাই নয়, সে যে কথাগুলো বলে গেল, সেগুলো খুব মূল্যবান। আশা করি, তার মূল্যবান কথাগুলো মগজে ঢুকিয়ে মানুষ হওয়ার চেষ্টা করবে। যদি কোনো দিন শুনি, তোমরা ওর পিছনে লেগেছ, তা হলে মনে রেখো, আমিই তোমাদেরকে জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করব। কথা শেষ করে ভাগ্নি ডালিয়াকে নিয়ে বাড়ি যেতে যেতে বললেন, ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, ঐ ছেলেটার সঙ্গে মহসিনের আগে কোনো ঘটনা ঘটেছিল। তুই কি এ ব্যাপারে কিছু জানিস?
লড়াই করার সময় শফির মোবাইল পড়ে গিয়েছিল। ডালিয়া সবার অলক্ষ্যে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে পেটকাপড়ে রেখেছিল। মামার কথা শুনে সেটাতে হাত বুলিয়ে দেখে নিয়ে সেদিনের ঘটনা জানিয়ে বলল, আমার ধারণা ছেলেটা যেদিন এখান দিয়ে তার নানার বাড়ি যায়, সেদিন মহসিন ভাই দেখে থাকবে এবং কবে ফিরবে সেখবরও রেখেছিল। তাই আগের ঘটনার অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বন্ধুদের নিয়ে ওতপেতেছিল।
হ্যাঁ মা, তোর কথা শুনে আমারও তাই মনে হচ্ছে। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস, ছেলেটার কী দূরন্ত সাহস? ভীন গায়ে এসে পাঁচ ছয়জন স্বসস্ত্র ছেলের সাথে খালি হাতে কীভাবে লড়াই করে তাদেরকে আহত করল?
মহসিনের সঙ্গে ডালিয়ার বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। তবু শফি লাঠি মেরে তার হাত ভেঙ্গে দিলেও তার মনে কোনো প্রক্রিয়া হয়নি বরং শফির সাহসিকতা ও লড়াই এর নৈপুণ্য তাকে মুগ্ধ করেছে। মামাকে শফির গুণগান করতে শুনে বলল, হ্যাঁ মামা আপনি ঠিক বলেছেন। প্রথম দিনের ঘটনা দেখে আমারও তাই মনে হয়েছিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ছেলেটাকে আপনি চেনেন?
হ্যাঁ চিনি। চরদৌলতখান গ্রামের ছেলে। দশ বছর বয়সের সময় হারিয়ে গিয়েছিল। ছেলের শোকে ওর বাবা একবছরের মধ্যে মারা যায়। তিন চার বছর পর ছেলেটার দাদি তার চাচাতো দেবরের ছেলের সঙ্গে ওর মায়ের বিয়ে দেন। কিছুদিন আগে ছেলেটা ফিরে এসেছে।
ডালিয়া অবাক হয়ে বলল, ওমা, তাই না কী? তারপর জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা ফিরে এসে মায়ের বিয়ের কথা জেনে কী করল?
তা আমি জানব কী করে? তবে ঐ গ্রামের একজন মেম্বারের কাছে শুনলাম, ছেলেটা ভালো, ধর্ম কর্ম মেনে চলে। তাই হয়তো মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিয়েছে।
ওদের আর্থিক অবস্থা কেমন?
পূর্বপুরুষদের অনেক জমি জায়গা ছিল, প্রতিপত্তিও ছিল। এখন ওয়ারীশ বেশি হয়ে যাওয়ায় আগের মতো অবস্থা নেই। তবে ওর বাবা মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় অন্যদের চেয়ে ভালো। ওর চাচাত চাচা জাকির হোসেনের সঙ্গে ওর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে হওয়ার পর সেইই জমি-জায়গা দেখাশোনা করছে। এবার হয়তো ছেলেটাই সেসব দেখাশোনা করবে।
ডালিয়া বলল, যদি উনি না দেন?
চেয়ারম্যান হেসে উঠে বললেন, বাবার সম্পত্তি ছেলেকে ফিরিয়ে দেবে না কেন? সেই তো এখন সব সম্পত্তির মালিক। এবার একটা কথা বলতো, ঐ ছেলেটার ব্যাপারে তুই এত কিছু জানতে চাচ্ছিস কেন?
প্রথম দিনের ঘটনার সময় শফিকে দেখেও তার কার্যকলাপ ও কথা বার্তায় ডালিয়া মুগ্ধ হয়েছিল। সকালে যখন মহসিনভাই তাকে বলল, ছেলেটা চার পাঁচদিন আগে আমাদের গ্রামের রাস্তা দিয়ে নানার বাড়ি গিয়েছিল আজ ফিরবে। তখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি কী সেদিনের বদলা নিতে চাও?
মহসিন বলেছিল হ্যাঁ, আজ ব্যাটাকে বুজিয়ে দেব কত ধানে কত চাল। এমন শিক্ষাদেব, আর কখনও আমার দিকে যেন চোখ তুলে চাইতে না পারে।