শফি বলল, আপনি ঠিক বলেছেন। যা বলেছি সব বানানো। যিনি আমাকে নিয়ে গিয়ে মানুষ করেছেন ফিরে আসার সময় তিনিই আমাকে ওয়াদা করিয়েছেন। আসল ঘটনা কাউকে যেন না বলি। বললে আমার ভীষণ ক্ষতি হবে। তা ছাড়া ওয়াদা ভঙ্গ করাও কঠিন গোনাহ। আর ওয়াদা ভঙ্গকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।
চার পাঁচ দিন নানা বাড়িতে থেকে ফেরার সময় শিকারমন্ডল গ্রামের রাস্তায় এসে দেখল, কয়েকটা যুবক ছেলের সঙ্গে চেয়ারম্যানের ছেলে মহসিন কথা বলছে। তখন তার সাথে কয়েকদিন আগে চরদৌলতখান গ্রামের রাস্তায় গোলমাল হওয়ার ঘটনা মনে পড়ল।
সেদিন মহসিন ফুপাত বোন ডালিয়ার সামনে শফির কাছে হেরে গিয়ে খুব অপমানিত হয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যেমন করে তোক এর বদলা নেবে। হঠাৎ কয়েকদিন আগে তাকে এই পথ দিয়ে যেতে দেখে কোথায় কাদের বাড়ি যাচ্ছে জানার জন্য রাসেল নামে একটা ছেলেকে তার পিছনে চর লাগিয়েছিল।
রাসেলের নানার বাড়িও নলছটি গ্রামে। সে শফির পিছু নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে করতে তার নানার বাড়িতে এল। আলাপ করার সময় শফি কবে ফিরবে জেনে নিল। আজ সকালে ফিরে এসে মহসিনকে সেকথা জানিয়েছিল।
মহসিন চার পাঁচজন বন্ধুকে সেদিনের ঘটনাটা সত্য মিথ্যা জানিয়ে শফিকে শায়েস্তা করার জন্য তাদেরকে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। মহসিনের কথামতো তারা পাঁচটা লাঠি রাস্তার ধারে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে।
কাছে এসে শফি চলন্ত অবস্থায় সবার উদ্দেশ্য সালাম দিল। কেউ সালামের উত্তর দিল না দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কী ভাই, আপনারা কেউ সালামের উত্তর দিলেন না যে? জানেন না, সালামের উত্তর দেয়া মুসলমানের জন্য ওয়াজিব? না দিলে ওয়াজিব তরকের গুণাহ হবে?
এই কথা বলার পরও যখন কেউ কিছু বলল না তখন মহসিনের দিকে চেয়ে বলল, আপনারা সবাই মুসলমান কিনা জানি না; কিন্তু সেদিন রবিউলের কাছে আপনার পরিচয় পেয়েছি। আপনি মুসলমান হয়েও সালামের উত্তর দিলেন না, এটা কি ঠিক করলেন?
মহসিন তার কথা গ্রাহ্য না করে বন্ধুদের ঈশারা করতেই তারা পাঁচজন পাঁচটা লাঠি নিয়ে শফিকে ঘিরে ফেলল।
শফি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি তো আপনাদের কোনো ক্ষতি করি নি। তবু কেন আমাকে লাঠিপেটা করতে চাচ্ছেন? যদি বলেন সেদিন মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম, তা হলে বলব আপনাদের উচিত হবে পুরো ঘটনা বাদি বিবাদীর কাছ থেকে জেনে তারপর কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়া।
মহসিন এতক্ষণ ধৈর্য ধরতে পারলেও আর পারল না। বলল, ঐ শালার কথা কী শুনছিস? মেরে তক্তা বানিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখ।
তার কথা শুনে শফি তাদেরকে দু’হাত তুলে থামতে বলে বলল, আগে মহসিন ভাই ওয়াদা করুক সেদিনের মতো রিভলবার বের করবেন না।
কেউ কিছু বলার আগে মহসিন বলল, ঠিক আছে, তাই হবে।
সবার আগে আমজাদ নামে একটা ছেলে শফির মাথায় লাঠির বাড়ি মারতে গেল।
শফি তার লাঠিটা ধরে কেড়ে নিয়ে তার একটা পায়ে বাড়ি লাগাল।
লাঠির বাড়ি খেয়ে আমজাদের মনে হল, পাটা ভেঙ্গে গেছে। লেংচে লেংচে সরে যেতে যেতে বলল, শালা আমার পা ভেঙ্গে দিয়েছে রে।
আমজাদের অবস্থা দেখে ও তার কথা শুনে বাকি চারজন একসঙ্গে শফিকে আক্রমণ করল।
শফি আমজাদের কেড়ে নেয়া লাঠি দিয়ে প্রথমে তাদের আক্রমণ। ঠেকাল। তারপর একে একে চারজনেরই একটা করে পা লাঠির বাড়ি মেরে ভেঙ্গে দিল।
পাঁচজনের একই অবস্থা দেখে মহসিন রাগের চোটে ওয়াদার কথা ভুলে গেল। তাড়াতাড়ি রিভলবার বের করে শফিকে গুলি করতে গেল।
শফি পাঁচজনের সঙ্গে লড়াই করলেও মহসিনের দিকে লক্ষ্য রেখেছিল। তাই তাকে রিভলবার বের করতে দেখে দ্রুত তার কাছে এসে রিভলবার ধরা হাতে খুব জোরে লাঠির বাড়ি মারল।
ততক্ষণে মহসিন ট্রিগার টিপলেও গুলি শফির গয়ে লাগল না।
তার রিভলবারটা ছিটকে দূরে পড়ে গেল। সে বুঝতে পারল, তার হাত ভেঙ্গে গেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করে হাত ধরে চিৎকার করে বলল, কে কোথায় আছ, তাড়াতাড়ি এসে এই শালা গুন্ডাকে ধরে বেঁধে ফেল। তারপর থানায় ফোন করে দারোগাকে পুলিশ নিয়ে আসতে বল।
গুলির শব্দ পেয়ে আশ পাশের ঘর থেকে অনেক লোকজন ও ছেলেমেয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। মহসিনদের ঘর একটু দূরে হলেও তার বাবাও বেরিয়ে এলেন। ওনার পিছন পিছন ডালিয়াও এল।
সবার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে শফি রিভলবারটা কুড়িয়ে মহসিনের দিকে তাক করে বলল, লোকজন কেউ আমার কাছে আসতে সাহস পাবে না। আর দারোদা পুলিশ নিয়ে আসার আগে আমি যদি আপনাকে এবং আপনার বন্ধুদের একটা করে গুলি করি, তা হলে কেমন হয়? তারপর দারোগা সাহেব এসে যখন সারজমিন করে পুরো ঘটনা জানবেন তখন আমাকে নয়, আপনাকে এবং আপনার এই বন্ধুদের এরেস্ট করে থানায় নিয়ে যাবেন। ভাববেন না, দারোগা সাহেবকে অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে ঘটনা। উল্টো দিকে নিয়ে যাবেন, তা হলে কেস আরও জটিল হবে। এই সব লোকজন কিন্তু আমার পক্ষে সাক্ষি দেবেন।
শফির কথা শুনে ও তার দিকে রিভলবার তাক করা রয়েছে দেখে মহসিনের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। কোনো কথা বলতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
তার অবস্থা দেখে শফি মৃদু হেসে বলল, ভয় নেই, গুলি করব না। জন্ম মৃত্যু আল্লাহর হাতে, তাই ছেড়ে দিলাম। তারপর আকাশের দিকে ফায়ার করে চেম্বার খালি করে রিভলবারটা লোকজনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মহসিনকে উদ্দেশ্য করে বলল, শুনেছি চেয়ারম্যান সাহেব আপনাকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য উচ্চ ডিগ্রী নেয়ার জন্য ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াচ্ছেন। আমার মনে হয় সেখানে আজে বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে মানুষ না হয়ে অমানুষ হয়েছেন। তারপর তার বন্ধুদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, মনে হয় আপনারা লেখাপড়া করলেও ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন নি। তাই আসল ঘটনা না জেনে ও ভালোমন্দ বিচার না করে মহসিন ভাইয়ের কথায় আমাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন। মনে রাখবেন মানুষ যতই উচ্চ ডিগ্রী নিক না কেন, সেই সঙ্গে যদি ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন না করে, তা হলে মানুষের মতো মানুষ হতে পারবে না। যাই হোক, আপনাদেরকে আহত করার জন্য দুঃখিত। তবে একেবারে ভেঙ্গে ফেলার জন্য খুব জোরে আঘাত করিনি। ডাক্তারের কাছে প্লাস্টার করিয়ে নিলে কিছুদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবেন। এবার আসি, আল্লাহ হাফেজ বলে শফি হাঁটতে শুরু করল।