সাজেদা খাতুনের বাবা অনেক বুঝিয়েও মেয়েকে রাজি করাতে পারলেন না। এরপর তিন বছর পার হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যবতী ও রূপবতী বৌকে কোননা পুরুষহীন ঘরে আগলে রাখা যে খুব কঠিন। তা জামিলা খাতুন এতদিনে বুঝতে পেরেছেন। তাই চাচাত দেবরের ছেলে জাকিরের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর যখন সাজেদাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিল তখন অমত করলেন না। বললেন, সাজেদার মতামত নিয়ে তোমাকে জানাব।
জমিলা খাতুন সাজেদার মা বাবাকে ডেকে পাঠালেন। ওনারা আসার পর সুবিধে অসুবিধের কথা জানিয়ে দেবরের ছেলে জাকিরের প্রস্তাব দেয়ার কথা জানালেন।
সাজেদার মা বাবা বললেন, এটা খুব ভালো কথা। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এ কাজ হলে বরং খুশি হব।
জমিলা খাতুন সাজেদাকে ডেকে ওনাদের সামনে সবকিছু বলে মতামত জানতে চাইলেন।
সাজেদা প্রথমে অনেক কান্নাকাটি করে অমত প্রকাশ করলেও মা বাবা ও শাশুড়ীর বোঝনর ফলে রাজি হলেন।
এর দশ পনের দিনের মধ্যে জাকির হোসেন সাজেদাকে বিয়ে করেন। তারপর থেকে জাকির হোসেন চাচির সংসার ও চাষাবাদ দেখা শোনা। করেন।
প্রায় বিশ বছর পর শফি ঘরে ফিরে এলে দাদি জমিলা খাতুন কেঁদে কেঁদে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।
সাজেদা খাতুনও ছেলের ফিরে আসার কথা শুনে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে স্বামীকে বললেন, আমি শফির সঙ্গে দেখা করতে যাব।
জাকির হোসেন বললেন, নিশ্চয় দেখা করবে। যাও, এক্ষুনি যাও।
শফি বাবা মারা গেছেন জেনে দুঃখ পেলেও মা আবার বিয়ে করেছে শুনে দুঃখ পাইনি। বরং খুশি হয়েছে।
সাজেদা খাতুন যখন এলেন তখন শফি দাদির সঙ্গে কথা বলছিল।
শফি অল্পক্ষণ ওনার দিকে চেয়ে থেকে চিনতে পেরে সালাম দিয়ে কদমবুসি করল। তারপর মা বলে জড়িয়ে ধরল।
সালামের উত্তর দিয়ে সাজেদা খাতুন ছেলের মাথায় চুমোখেয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল আল্লাহ তোকে একদিন না একদিন আমার কোলে ফিরিয়ে দেবেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এতদিন কোথায় ছিলি বাবা? একটা চিঠি দিয়েও এই হতভাগী মাকে খবর দিতে পারতিস? আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে কত খুশি হত।
শফিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, বিশেষ কারণে চিঠি দিতে পারিনি। তবু অন্যায় করেছি মাফ করে দাও মা বলে দু’পা জড়িয়ে ধরল।
মা ও ছেলেকে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করতে দেখে জমিলা খাতুন বৌকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বৌমা, এবার কান্নাকাটি থামাও। আল্লাহ তোমার মনের আশা পূরণ করেছেন, সেজন্য তার শুকরিয়া আদায় করে সবর কর।
সাজেদা খাতুন কান্না থামিয়ে শাড়ির আঁচলে নিজের চোখ মুখ মুছে ছেলের মুখ মুছে দেয়ার সময় বললেন, এতদিন কোথায় ছিলি বললি না যে?
শফি বলল, ওসব কথা এখন থাক, পরে এক সময় বলব।
সাজেদা খাতুন বললেন, আবার চলে যাবি না তো?
শফি বলল, না মা যাব না।
সাজেদা খাতুন বললেন, এখন যাই, পরে আসব বলে চলে গেলেন।
এরপর থেকে সাজেদা খাতুন বর্তমান স্বামীর সংসার করলেও প্রতিদিন এবাড়িতে শফির সঙ্গে দেখা করতে এসে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে যান। একদিন তিনি সুযোগ মতো শফিকে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো কারণে তুই কি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছিস?
শফি বলল, আমার ব্যবহারে সেরকম কিছু কি তুমি দেখতে পেয়েছ?
সাজেদা খাতুন বললেন, না, তা পাইনি। তবু জিজ্ঞেস করলাম।
শফি বলল, আল্লাহ যদি মেহেরবানী করে ধর্মের জ্ঞান না দিতেন, তা :হলে হয়তো তোমার দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারতাম না। ধর্মীয় জ্ঞান থাকার ফলে তোমার প্রতি এতটুকু অসন্তুষ্ট না হয়ে বরং সন্তুষ্ট হয়েছি। তুমি অন্যের স্ত্রী হলেও আমার মা। ছেলের কাছে মা কী জিনিস সে জ্ঞানও আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তুমি দোয়া করো মা, “আল্লাহ যেন সেই জ্ঞান মোতাবেক তোমার সেবা যত্ন করার তওফিক আমাকে দেন”।
ছেলের কথা শুনে সাজেদা খাতুনের কলিজা জুড়িয়ে গেল। ভিজে গলায় বললেন, আল্লাহ তোকে আরও ধর্মীয় জ্ঞান দিক, তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুক। দু’চার দিন পরে তোর নানাদের বাড়িতে গিয়ে সবাইকে দেখা দিয়ে আয়। তোকে দেখে সবাই খুশি হবে। এখন যাই, পরে আবার আসব, হাতের কাজ ফেলে এসেছি বলে চলে গেলেন।
০৩. চেয়ারম্যান সালাউদ্দিনের বাড়ি
চেয়ারম্যান সালাউদ্দিনের বাড়ি চরদৌলতখান থেকে তিন চার কিলোমিটার উত্তরে শিকারমন্ডল গ্রামে। এই গ্রামের রাস্তা দিয়ে শফির নানাবাড়ি নলছটি যেতে হয়। সপ্তাহ খানেক পরে শফি নানাবাড়ি গেল। তাকে দেখে নানা-নানি, মামা মামি এবং তাদের ছেলেমেয়েরা যেমন অবাক হলেন, তেমনি খুশিও হলেন। আদর আপ্যায়নের পর সবাই তার কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর এতদিন কোথায় ছিল এবং কিভাবে ফিরে এল জানতে চাইল।
শফি জানত নানা বাড়িতে এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই কী বলবে আগেই ভেবে রেখেছিল। এখন তাদের কথার উত্তরে বলল, কেমন করে হারিয়ে গিয়ে ছিলাম মনে নেই। যেখানে মানুষ হয়েছি সেখানে থাকার সময় এখানকার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আর কেমন করে ফিরে এলাম তাও জানি না। ফিরে আসার পর ওখানকার সবকিছু ভুলে গেছি। মনে হচ্ছে এত বছর স্বপ্নের মতো কেটেছে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে মানুষ যেমন অনেক কিছু দেখে তারপর ঘুম ভেঙ্গে গেলে সেসব মনে থাকে না, আমারও ঠিক তেমনি মনে হচ্ছে। সবাই তার কথা বিশ্বাস করলেও তার নানা জহির উদ্দিন বিশ্বাস করেন নি। তাই একসময় গোপনে তাকে বললেন, তুমি ভাই যা কিছু বলেছ, তা সব বানানো। আসল ঘটনা বলতে শুনি।