ডালিয়া বলল, কোনো ধার্মিক ছেলেমেয়ে অধার্মিক ছেলেমেয়েকে পছন্দ করতে পারে না। মহসিন ভাইকে তো বলেছি, তুমি ধর্মকে ঠিকমতো জান ও মান তা হলে বুঝতে পারবে কেন আমি তোমাকে এড়িয়ে চলছি এবং আগের জীবনের পথ ত্যাগ করে ইসলামী পথে চলার চেষ্টা করছি।
নাজিয়া বলল, ছেলেটা সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রাহেলার জান ও ইজ্জত বাঁচিয়েছে বলে হয়তো তাকে পাওয়ার জন্য সে পাগল হয়ে উঠেছে; কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ছেলেটার সঙ্গে তেমন দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ হয়নি, তবু তার কারণে তোমার এত পরিবর্তন হল কেন বুঝতে পারছি না।
ডালিয়া বলল, ছেলেটা যে শুধু দেখতে খুব হ্যাঁন্ডসাম তাই নয়, তার কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার ও চরিত্রের দৃঢ়তা যারা জানবে, শ্ৰেণীমতো সবাই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে বাধ্য হবে। আর ম্যাচিওর মেয়েরা তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠবে।
নাজিয়া বলল, এতক্ষণে বুঝতে পারলাম তুমিও তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছ। আর সেই জন্যেই ধার্মিক হওয়ার চেষ্টা করছ এবং মহসিন ভাইকে তারই কারণে এখন আর পছন্দ করছ না, কি ঠিক বলি নি?
ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ; তবে বুঝতে অনেক লেট করেছ।
নাজিয়া বলল, কিন্তু ছেলেটাও যে তোমাকে চায় তাকি জেনেছ?
হ্যাঁ, জেনেছি।
তোমাদের তেমন মেলামেশা বা কথাবার্তা হয়নি বললে, তা হলে জানলে কীভাবে?
ফোনে আলাপ করে।
তোমরা কি প্রায় ফোনে আলাপ করো?
না, কয়েকদিন আগে মাত্র একবার আলাপ হয়েছে।
ছেলেটা করেছিল, না তুমি করেছিলে?
আমি করেছিলাম।
তুমি কি তাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছ?
হ্যাঁ।
ছেলেটাও কি তোমাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে?
হ্যাঁ।
কী করে বুঝলে? মাত্র একবার ফোনে আলাপ করে তা বোঝা অসম্ভব।
তোমার কথা হয়তো ঠিক; কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
কেন প্রযোজ্য নয়?
ওটা মনের ব্যাপার মুখে বলা যাবে না।
তুমি কি ডিটারমাইন্ড ঐ ছেলেকেই জীবনসঙ্গী করবে?
হ্যাঁ।
নাজিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসেন। ওনার কথা না হয় বাদ দিলাম; কিন্তু মাকে ম্যানেজ করবে কী করে? তিনি মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে যে তোমার বিয়ের কথা পাকা করে রেখেছেন, তা তুমিও জানো?
ডালিয়া বলল, হ্যাঁ জানি; কিন্তু আমি এখন বড় হয়েছি, ভার্সিটিতে পড়ছি, আমার ব্যক্তিগত মতামত আছে। জোর করে মা তো এই কাজ করাতে পারবে না। তবে মা যে এ ব্যাপারে আমার উপর খুব চাপ সৃষ্টি করবে তা জানি। একটা কথা বলে রাখি ভাবি, আল্লাহপাক ছাড়া দুনিয়ার কোনো শক্তিই আমার সিদ্ধান্তকে বদলাতে পারবে না।
কি জানি ভাই, তোমাকে নিয়ে আমার বেশ চিন্তা হচ্ছে।
তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, তকৃদিরে যা লেখা আছে তা হবেই।
তুমি বললে তোমার ভাইয়ার সঙ্গে আলাপ করতে পারি।
না ভাবি, এখন ভাইয়াকে কিছু বলার দরকার নেই। সময় হলে আমিই বলব ভাইয়ার সঙ্গে আলাপ করতে।
ঠিক আছে, এখন যাই বলে নাজিয়া তার কাছ থেকে চলে গেল।
প্রায় দশ বার দিন পর আজ সকালে শফির সঙ্গে ফোনে আলাপ করে যখন জানতে পারল, তাকে দেখার জন্য আজই সে আসছে তখন তার মনে আনন্দের তুফান বইতে শুরু করেছে। তার কি করা উচিত ভেবে ঠিক করতে না পেরে ভাবিকে কথাটা জানাল।
নাজিয়া বলল, মা জানতে পারলে হুলুস্থুল কান্ড করে বসবেন। তুমি বরং বাবাকে সবকিছু জানাও। উনি নিশ্চয় কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন।
ডালিয়া বলল, ঠিক বলেছ ভাবি। তারপর রুমে এসে বুয়াকে ডেকে বলল, বাবাকে বলবি আমি ডেকেছি। খবরদার, মা যেন জানতে না পারে।
তানভীর সাহেব ড্রইংরুমে বসে পেপার পড়ছিলেন। বুয়ার মুখে মেয়ে ডাকছে শুনে তার রুমে এসে বললেন, কীরে মা, কেন ডেকেছিস?
ডালিয়া জিজ্ঞেস করল, মা কি ঘুম থেকে উঠেছে?
তানভীর সাহেব ঘড়ি দেখে বললেন, কেন? তুই তো জানিস, সে আটটার আগে উঠে না। এখন সাতটা বাজে। তার কথা বাদ দিয়ে কেন ডেকেছিস বল।
তুমি বস বলছি।
তানভীর সাহেব বসে বললেন, কী বলবি তাড়াতাড়ি বল, অফিস যাওয়ার টাইম হয়ে আসছে।
ডালিয়া কিছুক্ষণ নিচের দিকে মুখ করে চিন্তা করতে লাগল কীভাবে কথাটা শুরু করবে।
তানভীর সাহেব অধের্য্য গলায় বললেন, চুপ করে আছিস কেন? কীজন্যে ডেকেছিস বলবি তো?
ডালিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, এবারে মামাবাড়ি গিয়ে সেখানকার একটা ছেলেকে ভালবেসে ফেলেছি। সে ধার্মিক। তার আদর্শ চরিত্র দেখে আমি মুগ্ধ। তাকে উপলক্ষ করে আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দিয়েছেন। কথা শেষ করে বাবার দিকে চেয়ে দেখল, বড় বড় চোখ করে তার দিকে রাগের সঙ্গে তাকিয়ে রয়েছে। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে না পেরে মুখ নিচু করে নিল।
তানভীর সাহেব কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। গম্ভীর স্বরে বললেন, এ তুই কী বলছিস? আমি কি আমার মেয়ের কথা শুনছি?
ডালিয়া মুখ নিচের দিকে করেই বলল, হ্যাঁ বাবা, এটা তোমার মেয়েরই কথা।
এর পরিণতির কথা ভেবেছিস? মহসিনের সঙ্গে তোর বিয়ের কথা পাকা হয়ে রয়েছে। এ কথা তোর মা শুনলে কী করবে তাও কি ভেবেছিস? তা ছাড়া ছেলেটা তোর মামাদের গ্রামের বললি, তোর মামা জানতে পারলে কী ঘটনা ঘটবে তাও ভেবে দেখবি না? না, না, এ হতেই পারে না। মহসিন শুনলে সে কী করবে তাও কী ভেবে দেখবি না? পাড়াগাঁয়ের ছেলেরা শহরের সমাজ সম্পর্কে একরকম কিছুই জানে না। তারা আনকালচার্ড। আমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারবে না। তা ছাড়া পাড়াগাঁয়ের ছেলেরা খুব লোভী হয়। ঐশ্বর্যের লোভে বড় লোকের মেয়েদেরকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে। তারপর শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসার জন্য স্ত্রীর উপর অত্যাচার করে। এরকম ঘটনা যে পেপারে প্রায় লেখালেখি হচ্ছে তা তুইও জানিস। আর তোর মা যে নিজের মতের বাইরে কিছুতেই কোনো কাজ করে না, তাও তুই জানিস। তাই যা বলছি শোন, ভালোকে সবাই ভালোবাসে। তাই বলে তাকে পেতে হবে এটা তো ঠিক না। ওসব পাগলামী মাথা থেকে দূর করে দিয়ে ছেলেটাকে ভুলে যা মা। নচেৎ আমাদের সংসারে আগুন জ্বলবে।