চেয়ারম্যান কিছুক্ষণ শফির আপাদমস্তক দেখে বললেন, তাই না কি? দেখে মনে হচ্ছে এখন ওর বয়স প্রায় ত্রিশের মতো। তা এই বিশ বছর কোথায় ছিল? এত বছর পর ফিরেই বা এল কী করে? তা ছাড়া ওযে আমিনুল ইসলামের হারিয়ে যাওয়া ছেলে তার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে? আজকাল তো মাঝে মধ্যে শোনা যায়, মতলববাজ লোকেরা খোঁজ খবর নিয়ে সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য নিজেদের একজনকে হারান ছেলে সাজিয়ে পাঠিয়ে দেয়। এটা সেরকম কোনো ব্যাপার নয়তো? শুনেছি আমিনুল ইসলাম অনেক সম্পত্তি রেখে মারা গেছেন।
সামাদ মেম্বার বললেন, আমার যতদূর বিশ্বাস সেরকম কিছু নয়। আমিনুল ইসলামের মা বেঁচে আছেন। তিনি খুব ধার্মীক ও বিচক্ষণ মহিলা। প্রমাণ না পেলে তিনি কী ওকে গ্রহণ করতেন। তা ছাড়া গতকাল আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কথাবার্তায় তেমন কোনো সন্দেহ হয়নি। ওর বাবার। সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। তেমন কিছু হলে আত্মীয়-স্বজনেরাই বা মেনে নিল কেন?
চেয়ারম্যান শফির দিকে তাকিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলেন।
ওনার কথা শুনে শফি বুঝতে পারল, চেয়ারম্যান খুব ঘাগু লোক। নাম জিজ্ঞেস করতে নাম বলে মুখ নিচু করে নিল।
কেন কী জানি শফিকে খুব ভালো ছেলে বলে মনে হল চেয়ারম্যানের। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, একদিন আমাদের বাড়িতে এস, আলাপ করব। তারপর সামাদ মেম্বারকে বললেন, চলুন যাই।
যেতে যেতে সামাদ মেম্বার বললেন, কয়েকদিন মাত্র ফিরে এসেছে, এরই মধ্যে ছেলেটার অনেক গুণ প্রকাশ পেয়েছে।
চেয়ারম্যান বললেন, যেমন?
ছেলেটা খুব নামাযি পরহেজগার, সারারাত নাকী মসজিদে এবাদত করে, গরিবদের প্রতি খুব দয়ালু, তাদেরকে আর্থিক সাহায্য করে, ওর পানি পড়াতে অনেকের অসুখ ভালো হয়ে গেছে।
চেয়ারম্যান হেসে উঠে বললেন, তা হলে তো ওর জন্য এখানকার ডাক্তারদের রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে।
সামাদ মেম্বার বললেন, আপনি যাই বলেন, আমার পাঁচ বছরের নাতি পেট ব্যথায় খুব ছটফট করছিল। আমার ছেলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তায় ওর সঙ্গে দেখা হতে নাতির কান্নার কারণ জেনে পাশের চায়ের দোকান থেকে এক কাপ পানি নিয়ে কিসব পড়ে ফুঁ দিয়ে খাইয়ে দিল। খাওয়ার দু’এক মিনিটের মধ্যে নাতির পেটের ব্যথা ভালো হয়ে গেল।
চেয়ারম্যান কিছু না বলে চুপ চাপ হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করতে লাগলেন, সামাদ মেম্বারের কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে ছেলেটার গুণ আছে বলতে হয়।
০২. মাদারীপুর জেলার চর দৌলতখান গ্রাম
মাদারীপুর জেলার চর দৌলতখান গ্রামের মল্লিকদের আর্থিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। মুহাম্মদ শফি ওরফে শফি এ বংশের আমিনুল ইসলাম মল্লিকের একমাত্র সন্তান। শফি দেখতে খুব সুশ্রী। স্মরণশক্তি প্রখর। দশ বছর বয়সে কুরআনের হাফেজ হয়। সেই সাথে ফাঁইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তি পায়।
একই গ্রামের দূর সম্পর্কের ভাই রবিউলের সঙ্গে শফির খুব ভাব। একদিন বিকেলে রবিউল ও পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করার সময় শফি হারিয়ে যায়। বাবা আমিনুল ইসলাম ও আত্মীয়রা অনেক খোঁজাখুজি করেও পাইনি। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে মা সাজেদা খাতুন। খুব কান্নাকাটি করতে থাকেন। বাবা আমিনুল ইসলাম কান্নাকাটি না করলেও বেশ ভেঙ্গে পড়েন এবং বছর খানেকের মধ্যে হঠাৎ একদিন মারা যান।
শফির দাদা কুরআনের হাফেজ ছিলেন। ওনার ছেলে আমিনুল ইসলামকেও হাফেজ করার জন্য হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যে খুব কঠিন অসুখ হয়ে আমিনুল ইসলামের মেধা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। কোনো রকমে দাখিল পর্যন্ত পড়ে আর পড়াশোনা করেনি। বাবার সঙ্গে জমি-জায়গা দেখাশোনা করতেন। ছেলের বিয়ে দেয়ার দু’বছর পর আমিনুল ইসলামের বাবা মারা যান। আমিনুল ইসলাম খুব সুপুরুষ ছিলেন। পরিশ্রমীও ছিলেন। বাবা অনেক সম্পত্তি রেখে গেলেও বিভিন্ন কাজ কর্ম করে ও নিজের জমি-জায়গা আবাদ করে আরও অনেক সম্পত্তি বাড়ান।
তিনি মারা যাওয়ার পর ওনার স্ত্রী সাজেদা খাতুন প্রায় তিন বছর শাশুড়ী জমিলা খাতুনের কাছে থাকেন। এর মধ্যে আমিনুল ইসলামের চাচাত ভাই জাকির হোসেনের স্ত্রী-দুই ও চার বছরের দু’টো ছেলে মেয়ে রেখে মারা যান। স্ত্রী মারা যাওয়ায় ছেলেমেয়ে দুটোর কষ্ট দেখে আবার। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সাজেদাকে বিয়ে করার জন্য চাচি জামিলা খাতুনের কাছে প্রস্তাব দেন।
সাজেদা খাতুন সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী। শফি তার একমাত্র সন্তান। শফি হারিয়ে যাওয়ার পর কেঁদে কেঁদে ও ঠিকমতো না খেয়ে না ঘুমিয়ে স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছিল। ইদানিং আবার আগের মতো স্বাস্থ্য ফিরে এসেছে।
সাজেদার বাবার অবস্থাও স্বচ্ছল। জামাই মারা যাওয়ার কিছুদিন পর একদিন এসে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কথা জমিলা খাতুনকে বললেন।
জমিলা খাতুন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার বিশ্বাস আল্লাহ চাহে তো শফি একদিন ফিরে আসবে। তবু বলব আপনারা মেয়েকে বলে দেখুন, সে যদি যেতে চায়, আমার আপত্তি নেই।
বাবাকে শাশুড়ীর সঙ্গে কথা বলতে দেখে সাজেদা খাতুন আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাশুড়ীর কথা শুনে সামনে এসে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি তোমার সঙ্গে যাব না। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, শাশুড়ীর মতো আমারও বিশ্বাস, শফি একদিন না একদিন আমার কোলে ফিরে আসবে।