আমিও ভালো আছি। তবে- বলে চিন্তা করতে লাগল, কিভাবে মনের কথা বলবে।
ডালিয়া নিশ্চয় বারবার ফোন করছে, এঞ্জেজ জেনে কী মনে করছে ভেবে শফি অস্থিরতা অনুভব করল। তাই রাহেলাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, কেন ফোন করেছেন বলবেন তো?
রাহেলা কিছু বলতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠল।
শফি বলল, কাঁদছেন কেন? ওরা কি আবার পিছনে লেগেছে?
রাহেলা সামলে নিয়ে বলল, ওরা আমার পিছনে আবার লাগবে কী, আপনার হাতে ধোলাই খেয়ে সবাই পঙ্গু হয়ে গেছে।
তা হলে কাঁদছিলেন কেন?
বললে বিশ্বাস করবেন?
শফির মন তাকে সাবধান করে দিল। রাহেলার কথার টোনে বুঝতে পারল, সে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। বলল, বিশ্বাস করার মতো হলে সবাই বিশ্বাস করবে।
আমি তো সবার কথা বলিনি, বলেছি আপনার কথা।
দেখুন, এমন কথা বলবেন না যা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন হবে।
কঠিন না সহজ জানি না, যা সত্য তাই বলছি, আমি আপনাকে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে ভালোবেসে ফেলেছি। বলুন আমাকে ফেরাবেন না?
কথাটা শুনে শফির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, কৌতুকেরও একটা সীমা আছে।
রাহেলা ভিজে গলায় বলল, মোটেই কৌতুক করছি না। বিশ্বাস করুণ আর নাই করুণ সত্যি কথাই বলছি।
এ রকম পাগলামী মথায় এল কেন? আপনার বাবা ও ভাইয়া আমাকে কি নজরে দেখেন তা জানেন; কিন্তু ওনারা যে আমাকে দুনিয়া থেকে গায়েব করে দিতে চান তা জানেন না। আর আপনিও তাদের দলে ছিলেন। কিছুদিন আগে নরপশুদের হাত থেকে আপনার ইজ্জত বাঁচিয়েছি বলে হয়তো আপনার মনের পরিবর্তন হয়েছে। তাই বলে এখন যা বললেন, তা যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তা আপনি একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন।
আমার মনের পরিবর্তনের কথা যা বললেন তা ঠিক। আর এটাও ঠিক, তারা আমাকে টুকরো টুকরো করে কেটে মাটিতে পুঁতে ফেলবে তবু আমার ভালোবাসাকে মেনে নেবে না।
তাই যদি জানেন, তা হলে মাথায় ঢোকা ভালোবাসার ভূতকে হত্যা করে ফেলুন।
আপনি বোধ হয় জানেন না, যার মাথায় একবার ভালোবাসার ভূত। ঢুকে, তাকে হত্যা করাতো দূরের কথা, মাথা থেকে তাড়াতেও পারে না।
শফি বলল, মানুষের জীবনে হবে না, পারবে না বলে এমন কিছু নেই। চেষ্টা করলে মানুষ কি না করতে পারে। চেষ্টার দ্বারা মানুষ পানিতে, আকাশে ভ্রমণ করছে। এমনকি বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহে যাচ্ছে। আর এতো সামান্য…
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রাহেলা বলে উঠল, নীতিকথা শোনার জন্য আপনাকে ফোন করিনি, করেছি ভালোবাসার অর্ঘ আপনার পায়ে দিতে, গ্রহণ করবেন কি না বলুন।
শফি বলল, নীতিবাক্য নাই শুনলেন, এবার যা বলছি মন দিয়ে শুনুন-আমার হৃদয় শূন্য আছে, না কেউ সেই আসনে ঢুকে পড়েছে, তা না জেনে ভালোবাসার অর্থ দেয়া আপনার উচিত হয়নি। আপনাকে অপমান করার জন্য কথাটা বলছি না অথবা মিথ্যে করেও বলছি না। আমি একটা মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসি। আর সেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমাদের বিয়ের কথাও একরকম পাকা হয়ে গেছে। এখন আপনিই বলুন, আমার কী করা উচিত। আমাকে ভালোবেসেছেন জেনে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে; কিন্তু সেই ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারছি না বলে খুব দুঃখ লাগছে। আমার মনে হয় ভালোবাসা যখন অন্তরের ব্যাপার এবং সেই ভালোবাসার সফলতার পথও বন্ধ তখন তা প্রকাশ না করে অন্তরেই চেপে রেখে বাস্তবকে মেনে নেয়াই উচিত। আমাকে যদি আপনি সত্যিই ভালোবেসে থাকেন, তা হলে যা বলব, মেনে নেবেন বলুন।
রাহেলা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বলুন।
আমাদের মিলনের পথ যখন বন্ধ তখন আমরা ভাইবোন সম্পর্ক করে আজীবন ভালোবাসাকে ধরে রাখতে পারি। এটা ছাড়া অন্য কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না।
তার কথা শুনে এবারে আরও বেশিক্ষণ চুপ করে থেকে রাহেলা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল অন্য কোনো পথ যখন ভোলা নেই তখন আপনার কথা মেনে নিলাম।
শফি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বুলল, আপনার কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম। একটা কথা বলব বলব করেও বলা হয় না। আজ অনেক রাত হয়েছে। পরে এক সময় বলব। কথা শেষ করে সালাম দিয়ে লাইন কেটে দিল। রাহেলা সালামের উত্তর দিয়ে মোবাইল অফ করে চিন্তা করল, কে সেই ভাগ্যবতী, যে নাকী শফির মন জয় করেছে। পরে শফিকে ফোন করে জানতে হবে।
১১. শিকরমন্ডল গ্রামের নূর-উদ্দিন খন্দকার
শিকরমন্ডল গ্রামের নূর-উদ্দিন খন্দকার খুব নামিদামি লোক ছিলেন। ওনার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে বড়। নাম সালাউদ্দিন। আর মেয়ে ছোট নাম শামিমা বেগম। দুই ভাই-বোনের বয়স যখন পনের ও বিশ বছর তখন নূর-উদ্দিন মারা যান। বিশ বছরের সালাউদ্দিনের উপর সংসারের দায়িত্ব পড়ল। ঢাকা ভার্সিটি থেকে উচ্চ ডিগ্রি নেয়ার ইচ্ছা থাকলেও বাবা মারা যাওয়ায় আইএ পাস করে আর পড়াশোনা করেননি। বাবা অনেক জমি-জায়গা রেখে মারা গেছেন। সেইসব দেখাশোনা করতে লাগলেন। আর একমাত্র বোন শামীমাকে গ্রামের কলেজ থেকে আইএ পাস করিয়ে ঢাকায় হোস্টেলে রেখে ভার্সিটিতে লেখাপড়া করান। মাস্টার্স করার সময় শামীমা বেগম তানভীর নামে ঢাকার মধ্যবিত্ত ঘরের একটা ছেলেকে ভালোবেসে গোপনে বিয়ে করেন। ফাঁইন্যাল পরীক্ষার পর ফোন করে প্রথমে ভাবিকে কথাটা জানান। ভাবি আখতার বানু স্বামী ও শাশুড়িকে কথাটা জানান।
কথাটা শুনে সালাউদ্দিনের মা ফজিলা বেগম খুব রেগে গিয়ে ছেলেকে বললেন, আমি কত করে বললাম, শামীমাকে আর বেশি পড়াবার দরকার নেই। এবার ওর বিয়ে দে। তা না করে বোনকে ঢাকার হোস্টেলে রেখে পড়াতে লাগলি। বোন মান ইজ্জত খুইয়ে কাকে বলতে কাকে বিয়ে করে ফেলল। তখন যদি আমার কথা শুনতিস, তা হলে এমন অঘটন ঘটত না।