ততক্ষণে ছেলেটা রাগে ফুলতে ফুলতে হুণ্ডায় উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, এর প্রতিশোধ না নিয়েছি তো আমি বাপের বেটাই না। তারপর মেয়েটিকে হুণ্ডা ছেড়ে দিতে বলল।
রবিউল তাদের দিকে চেয়েছিল। শফির কথা শুনে যেতে যেতে বলল, আর দু’এক সেকেণ্ড দেরি হলেই তুই গুলি খেতিস।
তা খেতাম। তাই তো গুলি করার আগেই ওর হাতটা ধরে ফেললাম।
তুই কি জানতিস ওর কাছে রিভলবার আছে?
জানতাম বলেই তো সতর্ক ছিলাম।
কী করে জানলি বলতো। সে কথা বলা যাবে না।
আচ্ছা, অনেক সময় তুই আগে থেকে জানতে পারিস, কী করে পারিস বলবি?
তাও বলা যাবে না। তবে এতটুকু বলতে পারি, কোনো কিছু ঘটার আগে আমার মন আমাকে বলে দেয়। ওসব কথা বাদ দেতো।
রবিউল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ওদেরকে আমি চিনি। ছেলেটার নাম মহসিন। পাশের গ্রামের বড়লোকের ছেলে। ওর বাবা এই এলাকার চেয়ারম্যান। নাম সালাউদ্দিন, মেয়েটা মহসিনের ফুপাতো বোন। ঢাকায় বাড়ি। কয়েকদিন হল মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। মহসিন ঢাকায় ফুফুর বাসায় থেকে ভার্সিটিতে পড়ে। মনে হয় তোকে ছেড়ে কথা বলবে না। সময় সুযোগমতো আজকের অপমানের বদলা নেবে।
শফি বলল, ও বড়লোক চেয়ারম্যানের ছেলে, তাতে আমার কী? তাকে আমি অপমান করিনি। নিজের অহংকারের জন্য নিজেই অপমানিত হয়েছে। যদি বদলা নিতে আসে, তা হলে আরও বেশি অপমানিত হবে।
রবিউল জানে ছোটবেলায় যখন একসঙ্গে খেলাধুলা করত তখন শফি যা বলত তাই করত। সেই কথা মনে পড়তে ভাবল, এখনও কি ওর ঐ স্বভাব আছে? যদি থেকে থাকে, তা হলে মহসিন বদলা নিতে এলে তাকে আরও অপমান করে ছাড়বে। জিজ্ঞেস করল, একটা সত্যি কথা বলবি?
বল, তুই তো জানিস আমি কখনও মিথ্যা বলি না।
তোর আসল পরিচয় বলবি?
শফি হেসে উঠে বলল, পরিচয় আবার আসল নকল আছে না কি?
আমি এই গ্রামেরই ছেলে। ছোটবেলায় তোর সঙ্গে কত খেলাধূলা করেছি। তারপর না হয় হারিয়ে গিয়েছিলাম। এ কথা তো গ্রামের সবাই জানে, তুইও জানিস। তবু জিজ্ঞেস করছিস কেন?
হ্যাঁ, জানি। আমি জানতে চাচ্ছি হারানো জীবনটা কোথায়, কীভাবে কেটেছে এবং কীভাবে ফিরে এলি?
শফি আবার হেসে উঠে বলল, সেসব কথা জেনে কী লাভ হবে? তা ছাড়া সেসব বলাও যাবে না।
আচ্ছা, ছোটবেলার বন্ধুত্বের কথা নিশ্চয় মনে আছে?
হ্যাঁ, মনে আছে। তুই স্কুলে টিফিন নিয়ে আসতিস। টিফিন বাক্সে কী আছে খোলার আগে বলে দিতাম, সেকথা তোর মনে আছে?
হ্যাঁ, মনে আছে। আচ্ছা, এখনও সেরকম বলতে পারিস? পরীক্ষা করেই দেখ।
রবিউল জামার সাইড পকেট থেকে এক টাকার দুটো কয়েন হাতের মুঠোয় নিয়ে বের করে বলল, বলতো আমার হাতে কী আছে?
শফি সৃদু হেসে বলল, একটা লালচে ও একটা সাদা রং-এর দুটো কাঁচা টাকা আছে।
রবিউল খুব অবাক হয়ে বলল, কী করে বললি আমাকে শেখাবি?
শফি বলল, এটা শেখানোর বিষয় নয়। একটু আগে বললাম না, আমার মন আমাকে সবকিছু বলে দেয়।
আচ্ছা, তুই যখন এসে শুনলি বাবা মারা যাওয়ার পর তোর মা তার চাচাতো দেবরকে আবার বিয়ে করেছে তখন তোর মনের অবস্থা কী হয়েছিল? এবং ব্যাপারটা কীভাবে গ্রহণ করলি? মায়ের প্রতি তোর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে শফি বলল, ভার্সিটি থেকে উচ্চ ডিগ্রী নিলেও তুই ধর্মীয় বই-পুস্তক মনে হয় তেমন পড়াশোনা করিস নি। যদি করতিস, তা হলে এরকম প্রশ্ন করতে পারতিস না। শোন, একজন গ্রাম্য অল্পশিক্ষিত মেয়ে হয়ে মা যা করেছে, তা কল্পনাও করি নাই। আমার মনে হয়, মা অল্পশিক্ষিত হলেও ধর্মের জ্ঞান অনেক আছে। তাই চাচাতো দেবরকে আবার বিয়ে করে ইসলাম নারীদের যে অধিকার দিয়েছে, সমাজে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। তাই কথাটা শুনে খুশি হয়ে দু’রাকায়াত শোকরানার নামায পড়েছি।
তোর ঐ চাচা তোকে ছেলের মতো গ্রহণ করেছেন বলে হয়তো এই কথা বলছিস; কিন্তু উনি যদি তোকে গ্রহণ না করতেন, তা হলেও কি এই কথা বলতিস?
অফকোর্স! আমি এখন সাবালক, আমাকে চাচা গ্রহণ না করলেও ওনার প্রতি বা মায়ের প্রতি এতটুকু অসন্তুষ্ট হতাম না। এমন কী ওনাদের উপর এতটুকু মনকষ্টও হত না। এজন্য ওনারা আল্লাহর কাছে দায়ীও হতেন না। চাচা আমাকে গ্রহণ করে উদার মনের পরিচয় দিয়েছেন।
আর আমি যদি বলি, “তোর বাবার সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য উনি তোর মাকে বিয়ে করেছেন?
তা বলতে পারিস, তবে আমার সেরকম মনে হয়নি। তা ছাড়া চাচা যদি সেরকম ভেবে কাজটা করে থাকেন, তবুও ওনাকে দোষ দিতে পারব না। কারণ ঐ সময়ে মায়ের একজন গার্জেনের খুব দরকার ছিল।
এমন সময় চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন ও মেম্বার সামাদ মিয়াকে আসতে দেখে রবিউল বলল, ডান দিকের লম্বা চওড়া লোকটা চেয়ারম্যান, আর সঙ্গের হ্যাংলা পাতলা লোকটা সামাদ চেম্বার। ওনাদের সঙ্গে তোর পরিচয় হয়েছে?
শফি বলল, চেয়ারম্যানের সঙ্গে হয়নি, তবে সামাদ মেম্বারের সঙ্গে গতকাল হয়েছে।
ওনারা কাছাকাছি আসতে শফি ও রবিউল একসঙ্গে সালাম দিল।
চেয়ারম্যান রবিউলকে চেনেন। সালামের উত্তর দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা কেমন আছেন।
জি, ভালো আছেন।
তা তোমার সঙ্গের ছেলেটাকে তো চিনতে পারছি না। তোমাদের কোনো আত্মীয় না কি?
রবিউল কিছু বলার আগে সামাদ মেম্বার বললেন, ছেলেটা ওদের আত্মীয় হতে যাবে কেন? ওর নাম শফি। ওতো আমাদের গ্রামের মরহুম আমিনুল ইসলামের ছেলে। ন’দশ বছরের সময় হারিয়ে গিয়েছিল, কয়েকদিন হল ফিরে এসেছে।