মাতব্বর জিজ্ঞেস করলেন, এমন কি বলে থেমে গেলে কেন? নিশ্চয় আরও কিছু শিক্ষা দিয়েছে?
শফি বলল, মাফ করবেন দাদু বলতে পারব না।
ঠিক আছে, এবার বল ঐ লোকের পরিচয় জানতে পেরেছ কিনা।
অনেকবার জানতে চেয়েছি, বলেননি। শুধু এতটুকু বলেছেন আমি তোমার হিতাকাঙ্খী। ফিরে আসার কিছুদিন আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। বললেন, সে সময় আমার একটা ছেলে মারা যায়। তুমি দেখতে সেই ছেলের মতো। তাই তোমাকে নিয়ে এসে মানুষ করলাম। এখন তুমি তোমার মা বাবার কাছে ফিরে যাবে। কয়েক দিন পর এক সকালে নাস্তা খাওয়ার পর কেন কি জানি খুব ঘুম পেতে ঘুমিয়ে পড়লাম। এর আগে কোনো দিন এই সময়ে ঘুম পাইনি। জোহরের আজান শুনে ঘুম ভেঙ্গে যেতে দেখলাম যে জায়গায় খেলতে খেলতে নয় দশ বছরে হারিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে শুয়ে আছি। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়ের ধুলো ঝেড়ে চারপাশে তাকিয়ে সবকিছু চিনতে পারলাম। তখন সেই লম্বা চওড়া দাড়ি টুপি ওয়ালা লোকটার কথা ও বিগত বিশ বছরের কথা মনে পড়ল। শুয়ে থাকা জায়গার দিকে হঠাৎ দৃষ্টি পড়তে দেখলাম বেশ বড় একটা মুখবন্ধ খাম। খামটা নিয়ে খুলে একটা কাগজে লেখা দেখে পড়লাম, তোমাকে একদিন যেখান থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে দিয়ে গেলাম। আল্লাহ তোমাকে দোজাহানে সুখী করুক।
ইতি
তোমার হিতাকাঙ্খী।
খামের ভিতর যে অগুন্তিক টাকা ছিল শফি তা না বলে চুপ করে গেল।
মাতব্বর বললেন, তুমি ইচ্ছা করলে অনেক আগেই পালিয়ে আসতে পারতে, এলে না কেন?
ওখানে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে এখানকার সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম। আর এখানে ফিরে আসার পর আপনাকে যতটুকু বলেছি, সেগুলো ছাড়া ওখানকার সবকিছু ভুলে গেছি।
মাতব্বর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এরই মধ্যে তোমার সম্পর্কে ভালোমন্দ অনেক কথা আমার কানে এসেছে। তুমি একটু সাবধানে থেক। গ্রামের কোনো ব্যাপারে জড়াবে না।
শফি বলল, আপনার কথা যথাসাধ্য মেনে চলার চেষ্টা করব। তবে অন্যায় কিছু হতে দেখলে প্রতিবাদ করবই। কারণ এটা করা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের কর্তব্য। এটা হাদিসের কথা তাই না দাদু?
মাতব্বর তার সবকিছু শুনে বুঝতে পেরেছেন, কোনো মুসলমান ভালো, জিন ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে মানুষ করেছে। বললেন, হ্যাঁ, এটা হাসিদের কথা। তারপর বললেন, এবার ঘরে যাও, মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যেও।
ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় আসব বলে শফি সালাম বিনিময় করে চলে এল।
০৭. ডালিয়া মামা বাড়িতে ছিল
যতদিন ডালিয়া মামা বাড়িতে ছিল ততদিন শফিকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে নি। মামাবাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে এসেও শফিকে মন থেকে সরাতে পারছে না। মামার মুখে শফি খুব ধার্মিক শোনার পর থেকে ভেবেছে সেও ধার্মীক হবে। তাই ঢাকায় এসে ধার্মীক হবার সাধনা করছে। সেই সাথে শফির চিন্তা তাকে পাগল করে তুলেছে। ভালো করে পড়াশোনা করতে পারছে না, ঘুমাতে পারছে না, খেতেও পারছে না। ঘুমাবার সময়। চোখ বন্ধ করলেই মনের পাতায় শফির ছবি ভেসে উঠে। তার চোখের দৃষ্টি প্রেম সাগরে সাঁতার কাটার জন্য ডাক দেয়। তখন তার তনুমনুতে আনন্দের শিহরণ বইতে থাকে। মহসিন ভাইরের ফাঁইন্যাল পরীক্ষার পর তার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা পাকা হয়ে আছে জেনেও শফিকে মন থেকে তাড়াতে পারছে না। এক এক সময় ভাবে, কী ঝকমারি করে এবারে মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে তাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। যদি না যেত, তা হলে শফি নামে ছেলেটার সঙ্গে দেখাও হত না, আর তার দেহদৌষ্ঠব ও চোখের দৃষ্টি আমাকে পাগলও করত না। হঠাৎ তার মনে হল, আচ্ছা আমি যে শফিকে নিয়ে এত চিন্তা করছি, সেও কী আমাকে নিয়ে চিন্তা করছে? তখন তার মন বলে উঠল, নিশ্চয় করছে। তা না হলে মোবাইল সেট নিতে এসে কেন বারবার আমার মুখের দিকে চেয়ে দেখেছে? আমার বিশ্বাস সেও আমাকে নিয়ে চিন্তা করছে। শুধু তাই নয়, আমাকে পাওয়ার জন্য কোনো না কোনো প্ল্যান প্রোগ্রামও করেছে। কথাটা ঠিক কিনা তা তার মোবাইল নাম্বারে রিং করে দেখলেই হয়। কথাটা মনে হতে ভাবল, এতদিন কথাটা মনে হয়নি কেন? মনকে বলল, ফোন করলে যদি হিতে বিপরীত হয়? মন বলল, ওটা তোর দুর্বলতা, ফোন করেই দেখ। যা ভাবছিস তা কিছুই নয়।
ডালিয়া রাতে ঘুমাবার সময় এইসব চিন্তা করছিল। দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, রাত পৌনে বারটা। ভাবল, পাড়াগাঁয়ে দশটা এগারটা বাজলেই গভীর রাত মনে হয়। পৌনে বারটা পর্যন্ত কী শফি জেগে আছে। আর যদি জেগেও থাকে, ধার্মিক ছেলে হিসাবে আমার ফোন পেলে কী কথা বলবে অথবা অন্য কিছু কী ভাববে? মন বলল, যাই ভাবুক না কেন, তুই ফোন কর। দোনো মনো করে ডালিয়া ফোন করল।
.
শফি প্রতিদিন রাত দশটায় খাওয়া দাওয়া করে ঘন্টা দেড় দুই পৃথিবীর সমস্ত ইসলামিক রাষ্ট্রপতিরা কেন একতায় আসতে পারছে না তার কারণের উপর একটা থিসিস লিখে। আজও লিখছিল। মোবাইল বেজে উঠতে ঘড়ির দিকে চেয়ে ভাবল, এতরাতে কে আবার ফোন করল? অচেনা নাম্বার দেখে মনে করল, হয়তো কেউ রং নাম্বারে ফোন করেছে। কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল, কে আপনি? এতরাতে ফোন করেছেন কেন?