শফিও চাচার মনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। তাই চালাকি করে বলল, ফিরে আসার সময় ঢাকায় একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য দরখাস্ত করে এসেছি। সেটা যদি হয়ে যায়, তা হলে ঢাকা চলে যাব। তবে প্রতিমাসে মাসে আসব। আর যদি চাকরি না হয়, তা হলে হয়তো নিজের হাতে চাষবাস করব।
জমিলা খাতুন বললেন, তোর চাকরির দরকার কী? তোর বাপের যা। জমি জায়গা আছে, তা দেখাশোনা করলে রাজার হালে থাকবি।
শফি হেসে উঠে বলল, দাদি, আপনি কি জানেন, একটা রাজার কত বিষয় সম্পত্তি থাকে?
তা না জানলেও তোর বাপের যা আছে, সাতপিড়ী বসে খেলেও শেষ হবে না। এই শেষ বয়সে তোকে আমি চাকরি করতে ঢাকায় যেতে দেব না। তুই ঢাকায় গেলে আমাকে দেখাশোনা করবে কে?
আমি কী একেবারে যাব নাকী? বললাম না, প্রতি মাসে আসব। প্রয়োজনে সপ্তাহে সপ্তাহে আসব।
শফি গ্রামে না থেকে ঢাকায় চাকরি করবে শুনে জাকির হোসেন খুশি হয়েছেন। তাই তার কথা শুনে চাচিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ও বোধ হয় এত বছর শহরে ছিল, গ্রামে ওর ভালো লাগছে না। তাই ঢাকায় চাকরি করতে চাচ্ছে। আমার মতে চাকরি করলে বিষয় সম্পত্তি আরও বাড়াতে পারবে। এতদিন আমি আপনার দেখাশোনা করেছি, প্রয়োজনে সারাজীবন করব। তা ছাড়া চাকরি পাওয়ার পর আমরা ওর বিয়ে দেব। ও ঢাকায় চাকরি করলেও বৌ এখানে থেকে আপনার সেবা যত্ন করবে।
চাচার কথা বার্তায় শফিও বুঝতে পেরেছে, তার বাবার সম্পত্তি গ্রাস করতে চেয়েছিলেন। না বোঝার ভান করে বলল, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। দাদিকে একটু বোঝান তো।
জমিলা খাতুন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগে শফি আবার বলল, আগে চাকরিটা পাই, তারপর এ ব্যাপারে আলাপ করা যাবে। মাও তখন। থাকবে।
জাকির হোসেন বললেন বেশ, তাই হবে। তারপর এবার আসি বলে চলে গেলেন।
.
চরদৌলতখান গ্রামের মাতব্বর সূরুজ মিয়া স্বনামধন্য লোক। ধর্ম কর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেন। আচার বিচারের সময় কারও পক্ষপাতিত্ব না করে খাঁটি বিচার করেন। বয়স প্রায় পয়ষট্টীর মতো। গরিবদের প্রতি খুব সদয়। প্রয়োজনে তাদেরকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন। সেজন্য ছোট বড়, ধনী-গরিব সবাই মান্য করে।
দাদির মুখে সেকথা জেনে শফি একদিন ওনার সঙ্গে দেখা করতে গেল। সালাম বিনিময় করে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, দাদু কেমন আছেন?
মাতব্বর আগেই শুনেছেন, মরহুম আমিনুল ইসলামের ছেলে প্রায় বিশ বছর পর ফিরে এসেছে। তাকে দেখেও তার কথা শুনে খুশি হলেন। বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তারপর তাকে বসতে বলে একজন কাজের বুয়াকে ডেকে নাস্তা নিয়ে আসতে বললেন।
শফি বলল, আমি নাস্তা খেয়ে এসেছি, আর খেতে পারব না। দাদির মুখে আপনার কথা শুনে দেখা করতে এলাম।
মাতব্বর বললেন, আরে ভাই, এই বয়সে খাওয়া পেটেও খাওয়া যায়। তা তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? কী করছিলে? কী করে ফিরে এলে বলতো ভাই। তোমার বাপতো তোমাকে খুঁজে খুঁজে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। শেষে হঠাৎ একদিন হার্টফেল করে মারা গেল।
বাবার কথা শুনে শফির চোখে পানি এসে গিয়েছিল। চোখ মুছে বলল, আল্লাহ বাবাকে জান্নাত নবীস করুণ, তাঁর গোরআযাব মাফ করে দিন। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, দাদি ও অনেকেই আমাকে একথা জিজ্ঞেস করেছেন; কাউকেই বলিনি। শুধু বলেছি সেকথা পরে বলব। আপনি মুরুব্বী ও আল্লাহওয়ালা মানুষ, আপনাকে বলতে বাধা নেই। তবে ওয়াদা করতে হবে, যা বলব কাউকেই বলবেন না। বললে আমার ভীষণ ক্ষতি হবে।
মাতব্বর মৃদু হেসে বললেন, কোনো মুসলমান কি আর এক মুসলমানের ক্ষতি করতে পারে? যদি কেউ করে, তা হলে সে প্রকৃত মুসলমান থাকবে না। ঠিক আছে, ওয়াদা করছি, এবার বল। এমন সময় কাজের মেয়ে নাস্তা নিয়ে এলে আবার বললেন, আগে নাস্তা খেয়ে নাও তারপর তোমার কথা শুনব।
নাস্তা খাওয়ার পর শফি বলতে আরম্ভ করল। আপনারা জানেন, আমি নয় দশ বছরের সময় খেলতে খেলতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তখনকার কথা তেমন মনে না থাকলেও যতটুকু মনে আছে বলছি-পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলতে খেলতে হঠাৎ একজন খুব লম্বা চওড়া দাড়ি টুপিওয়ালা লোক এসে আমার নাকে ও মুখে রুমাল চাপা দিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিল। আমি চিৎকার করতে চাইলাম; কিন্তু মুখ থেকে শব্দ বের হল না। তারপর আর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলাম পাকা বিল্ডিং এর একটা রুমের খাটে শুয়ে আছি। উঠে বসেছি এমন সময় সেই লম্বা চওড়া লোকটাকে রুমে ঢুকতে দেখে বললাম, আমাকে এখানে এনেছ কেন? আমি ঘরে যাব। লোকটা ইয়া বড় বড় লাল টকটকে চোখ বের করে বলল, এখানে থেকে তুমি লেখাপড়া করবে। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর ঘরে যেতে পারবে। আমি ঘরে আসার জন্য খুব কান্নাকাটি করতে লোকটা খুব রাগের সঙ্গে বলল, একদম কান্নাকাটি করবে না, যা যা বলব শুনবে। নচেৎ গলাটিপে মেরে ফেলব বলে আমার গলায় হাত দিল। আমি ভয় পেয়ে কান্না থামিয়ে বললাম, না-না আমাকে মেরে ফেলবেন না। আপনার সব কথা শুনব। আমার কথা শুনে লোকটা অনেক সুস্বাদু ফল খাবার খেতে দিল, সেই বিল্ডিংটা ছিল একটা মাদরাসার হোস্টেল। আমি আগেই হাফেজ হয়েছি। তাই আমাকে আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। টাইটেল পাশ করার পর ভার্সিটি থেকে আরবি ও ইংরেজীতে মাস্টার্স করি। লাঠিখেলা ও নানারকম অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দেন। শুধু তাই নয় কুংফু ও ক্যারাটেতে পারদর্শী করান। এমন কি জিন হাসিলের আমলও শিক্ষা দেন বলতে গিয়েও বলল না। চুপ করে গেল।