হ্যাঁ, জানে, বাবাই তো আপ্যায়ন করিয়ে মোবাইল সেট ফেরৎ দিতে বলে পাশের গ্রামে মিটিং-এ চলে গেল। আমি অবশ্য বাবাকে বলেছিলাম, ছেলেটা মোবাইল সেট নিতে এলে মোবারক চাচাকে দিয়ে তার হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিতে।
উৎফুল্ল হয়ে উঠে মহসিন বলল, বাহ! তুই তো খুব ভালো সাজেসান দিয়েছিলি, বাবা শুনল না কেন?
তুমি সবকিছুতে তাড়াহুড়ো করো। বাবা কী বলল শোনার আগেই কথা বলছ। তারপর বাবা যা বলেছে বলল।
মহসিন বলল, বাবার প্ল্যানটাও অবশ্য খুব ভালো। এবার বাছাধন বুঝবে কত ধানে কত চাল। সেই সময় যদি আমি মোবারক চাচার সঙ্গে থাকতে পারতাম, তা হলে মনের ঝাল মেটাতে পারতাম।
রাহেলা বলল, তোমার আশা পূরণ হবার নয়। কারণ তা হলে সবাই জেনে যাবে কাজটা বাবাই করিয়েছে।
মহসিন বলল, সেকথা ভেবেই তো আফশোস হচ্ছে।
রাহেলা বলল, আফশোস হলেও কিছু করার নেই। তবে যখন শুনবে মোবারক চাচা মেরে শফির হাত পা ভেঙ্গে লুলা করে দিয়েছে তখন বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি করো।
মহসিন বলল, তাতো করবই। তারপর বলল, হ্যাঁরে, রবিউল ওর সঙ্গে কেন এসেছিল? সে তো তোদের কলেজের প্রফেসর তাই না? প্রথম ঘটনার দিন ডালিয়া রবিউলকে দেখলেও মহসিন রাগের চোটে আশপাশের কাউকেই লক্ষ্য করেনি।
ভাইয়ার কথা শুনে রাহেলা বলল, রবিউল স্যার শফির বন্ধু। আর উনি কলেজের একজন প্রফেসর জানার পর ওনার সম্পর্কে সম্মান দিয়ে কথা বলা তোমার উচিত।
মহসিন রেগে উঠে বলল, তোকে আর মাস্টারী ফলাতে হবে না। যা এখান থেকে।
.
চেয়ারম্যান সালাউদ্দিনের গ্রাম থেকে প্রায় তিন চার মাইল দূরে লাঠিয়াল সর্দার মোবারকের বাড়ি। চেয়ারম্যান অনেকবার তাকে দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করেছেন। ছেলে ও তার বন্ধুদের পরিণতি ও শফির বাহাদূরী দেখে খুব অপমানিত হয়েছেন। উনি খুব বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোক। তাই তখন অপমানিত হয়েও শফির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন।
সেই সাথে মনে মনে প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করেছেন। বাজারে ওনার চালের আড়ৎ আছে। শফি চলে যাওয়ার পর আড়তে এসে একজন লোকের দ্বারা মোবারক লাঠিয়ালকে ডেকে পাঠালেন।
প্রায় দু’ঘন্টা পরে মোবারক লেঠেল এসে সালাম বিনিময় করে বলল, কেন ডেকেছেন বলুন সাহেব।
চেয়ারম্যান শফির নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে রেখেছিলেন। সেটা তার হাতে দিয়ে কী করতে হবে না হবে বললেন। তারপর তাকে দু’হাজার টাকা দিয়ে বললেন, কাজ শেষ করে এসে তিন হাজার নিয়ে যেও। আর শোনো, ছেলেটা সব দিকে তুখোড়। দরকার মনে করলে সঙ্গে দুতিন জনকে নিও। একেবারে জানে মারবে না। হাত পা এমনভাবে ভেঙ্গে দেবে। যেন চলা ফেরা করতে না পারে। যদি লাঠির দ্বারা কাবু করতে না পার তোমার তো লাইসেন্স করা পিস্তল আছে, সেটা দিয়ে এমন সব জায়গায়। গুলি করবে, যেন হাত পা কেটে বাদ দিতে হয়। তবে খুব সাবধান, কেউ যেন জানতে না পারে আমি তোমাকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছি।
চেয়ারম্যান থেমে যেতে মোবারক বলল, ঠিক আছে সাহেব আপনি তো জানেন, মোবারক কোনো ফ্লু রেখে কাজ করে না। ছেলেটা যতই তুখোড় হোক এই মোবারকের কাছে নস্যি। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল।
মোবারকের বয়স এখন পঞ্চাশের মতো হলেও শক্তি সামর্থে পাঁচ-দশ জন লেঠেলকে কাবু করতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগে। ফেরার পথে চিন্তা করল, আগে ছেলেটাকে চিনতে হবে। তারপর কাজে নামতে হবে।
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, সঙ্গে দু’তিনজন লোক নিতে সত্যি কী ছেলেটা খুব তুখোড়? দেখলে বোঝা যাবে কত তুষোড়।
.
একদিন জাকির হোসেন চাচি জমিলা খাতুনের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, শফি কী আপনাকে জমি-জায়গার ব্যাপারে কিছু বলেছে?
জমিলা খাতুন বললেন, না কিছু বলেনি। ওকি ওর বাবার জমি-জমা চাষাবাদ করবে কিনা জিজ্ঞেস করেছেন?
না, করিনি।
ওকে জিজ্ঞেস করবেন। যদি নিজে সবকিছু চাষাবাদ করে, তা হলে তো ওকে সব জমি-জায়গা দেখিয়ে দিতে হবে।
এমন সময় শফি এসে সালাম দিয়ে বলল, চাচা, কেমন আছেন? জাকির হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ভালো আছি।
জমিলা খাতুন নাতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোর চাচা জানতে এসেছে, তুই তোর বাপের জমি-জমা চাষ করবি কিনা।
শফি চাচার দিকে চেয়ে বলল, না আমি জমি-জমা চাষ করব না। আপনি যেমন করছেন করবেন, তবে ভাগচাষি হিসাবে যা ফসল হবে খরচ। বাদ দিয়ে অর্ধেক ফসল দেবেন। আর মা তার স্বামীর ১/৮ অংশ পাবে। সেটা মাকে দলিল করে দেব। সেই জমির ফসলের ভাগ দিতে হবে না। মা সব ফসল পাবে। বাবার সব জায়গা-জমি আমাকে দেখিয়ে শুনিয়ে বুঝিয়ে দেবেন। ফসলী জমি ছাড়া বাকি সবকিছু আমি দেখাশোনা করব।
শফি ফিরে আসায় জাকির হোসেন খুশি হননি। ওনার ইচ্ছা ছিল জমিলা খাতুন মারা যাবার পর শফির বাবার সবকিছু এমন কি বাস্তভিটা পর্যন্ত গ্রাস করার। সেই ইচ্ছা পূরণ হবে না ভেবে হতাশ হয়েছেন। তবু মনে করেছিলেন, জমা-জমি ও অন্যান্য সবকিছু দেখাশোনা করে যতটা পুশিয়ে নেয়া যায় সেই ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এখন শফির কথা শুনে সে আশাও তার পূরণ হবে না ভেবে তার প্রতি খুব অসন্তুষ্ট হলেও তা বাহিরে প্রকাশ না করে বললেন, বেশ তাই হবে।
দেবর পুতের মনের খবর জমিলা খাতুন শফি ফিরে আসার আগে কিছুটা অনুমান করেছিলেন। এখন তার মুখের অবস্থা দেখে সেই অনুমান আরও দৃঢ় হল। নাতির কথা শুনে তাকে বললেন, তুই সবকিছু নিজে চাষবাস করবি না কেন?