শফিকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে বাবা যা কিছু বলেছেন, সেসব বলে বলল, আজ ছেলেটা এলে তোকে ও আমাকে আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিতে বলেছে। তুই কী বলিস?
ডালিয়া বলল, আমি আবার কী বলব? এটা তোদের ব্যাপার তোরা বুঝবি।
রাহেলা বলল, তা ঠিক। তবে আপ্যায়ন করানোর সময় বাবা তোকেও আমার সঙ্গে থাকতে বলেছে। থাকবি তো?
কথাটা মামার মুখে শোনার পর থেকে ডালিয়ার তনুমনুতে আনন্দের। শীহরন খেলছে। এখন আবার রাহেলার কথা শুনে সেই শীহরণ আরও বেড়ে গেল। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে থাকব।
০৫. রবিউল ও শফির মধ্যে বন্ধুত্ব
ছোটবেলায় রবিউল ও শফির মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। শফি হারিয়ে যেতে রবিউলের মন অনেক দিন খারাপ ছিল। তারপর আস্তে আস্তে তাকে ভুলে। গেলেও মাঝে মধ্যে মনে পড়ত। রবিউলের বাবা জহির উদ্দিন চৌধুরী বেশ অবস্থাপন্ন লোক। ওনার শুধু চার ছেলে। কোনো মেয়ে নেই। রবিউল সবার ছোট। বড় তিন ভাই লেখাপড়া শেষ করে ঢাকায় চাকরি করে। তারা ঢাকাতেই ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। রবিউল বড় ভাইয়ের কাছে থেকে ঢাকা কলেজ থেকে মাস্টার্স করে গ্রামে এসে বাবার ঘাড়ে বসে একবছর খেয়েছে। এই মাস ছয়েক হল গ্রামের কলেজে অধ্যাপনা করছে। বড় ভাইয়েরা ও ভাবিরা ঢাকাতে চাকরি করার কথা বললেও সে রাজি হয়নি। তাদেরকে বলেছে তোমরা মা বাবাকে ছেড়ে শহরে এসে বাস করছ। আমি তা করব না আর ওনাদের ছেড়ে থাকতেও পারব না।
রবিউল গ্রামের স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ার সময় থেকে রাহেলাকে ভালবাসত, কিন্তু সেকথা রাহেলাকে বলার সাহস হয়নি। রাহেলা তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। তখন অবশ্য রাহেলার বাবা চেয়ারম্যান ছিলেন না। স্কুলটা ছিল চরদৌলতখান ও শিকরমণ্ডল গ্রামের মধ্যস্থলে। গ্রামের কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে রবিউল ঢাকায় পড়াশোনা করতে গেলেও রাহেলাকে ভুলতে পারে নি। মাস্টার্স কমপ্লীট করে গ্রামে ফিরে যখন ভার্সিটি অধ্যাপনা শুরু করল তখন রাহেলা ঐ কলেজে ডিগ্রী সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। ক্লাস নেয়ার সময় চোরা চোখে রবিউল তাকে দেখে। ছয় সাত বছর আগের কিশোরী রাহেলা এখন যুবতী। ছোটবেলা থেকে রাহেলা রূপসী। যৌবনে এসে আরও অনেক বেশি রূপসী হয়েছে। রবিউল সিদ্ধান্ত নেয় যেমন করে হোক ওকে বিয়ে করবেই।
কলেজে অধ্যাপনা শুরু করার পাঁচ ছয় মাসের মধ্যে দীর্ঘ বিশ বছর পর শফি ফিরে এলে দু’জনের মধ্যে আবার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। এখন পর্যন্ত রাহেলাকে ভালবাসার কথা তাকে জানাইনি।
শফি মোবাইলের লাইন কেটে দিতে রবিউল জিজ্ঞেস করল, কী রে মোবাইল ওদের কেউ পেয়েছে?
হ্যাঁ, পেয়েছে। বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে নেয়ার জন্য ডেকেছে।
যাবি না কি?
হ্যাঁ, যাব। তুইও আমার সঙ্গে যাবি।
গেলে রাহেলার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে খুশি হলেও রবিউল বলল, আজকেই যাওয়াটা কী ঠিক হবে?
ঠিক হবে না কেন?
না, বলছিলাম কী, আজ যে ঘটনা ঘটিয়ে এসেছিস তারপর যাওয়াটা ঠিক হবে না।
তুই অত ভীতু কেন? আমি কিন্তু আল্লাহকে ছাড়া কাউকেই ভয় করি না
তা জানি। তবু বলব আজ না গিয়ে কাল যা।
তুই বার বার যেতে নিষেধ করছিস কেন বলতো?
রবিউল জানে মহসিন খুব রাগি ও গুণ্ডা টাইপের। দু’দুবার যার কাছে অপমান হয়েছে, তাকে পেলে নির্ঘাৎ গুলি করবে। সেকথা বলে বলল, কাল আজকের মতো মহসিনের অতটা রাগ থাকবে না। তাই কাল যেতে বলছি।
শফি বলল, ওর হাতে আমার মৃত্যু থাকলে হবে, না থাকলে গুলি করলেও হবে না। তা ছাড়া ওনাকে আজই যাব বলেছি।
তাতে কী হয়েছে? এখন আবার ফোন করে জানিয়ে দে কাল যাবি।
না আজই যাব। তুই যদি যেতে না চাস, আমি একাই যাব। তবু কথার বরখেলাপ করতে পারব না।
রবিউল জানে শফি ছোটবেলা থেকে খুব একরোখা, যা করবে বলবে তা করেই ছাড়ে। এখনও সেই স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি দেখে বলল, তুই সেই আগের মতই রয়ে গেছিস। ঠিক আছে, আজই যখন যাবি বলছিস তখন আর কী করা। আমিও তোর সঙ্গে যাব।
শফি বলল, কী জানিস, মোবাইলে যার সঙ্গে কথা বললাম, সে চেয়ারম্যানের মেয়ে রাহেলা। মারামারি হওয়ার সময় তাকে দেখিনি, দেখেছি ডালিয়াকে। মোবাইল কুড়ালে কুড়াবে ডালিয়া; কিন্তু রাহেলা বলল, তার কাছে মোবাইল আছে। আর সেই-ই যেতে বলল।
রবিউল বলল, হয়তো ঘটনার সময় রাহেলা ছিল না; ডালিয়াই কুড়িয়েছে। পরে ঘটনা জানার পর ডালিয়ার কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়েছে।
শফি বলল, মনে হয় তোর কথাই ঠিক।
দু’বন্ধুতে যখন শিকরমন্ডলে পৌঁছাল তখন মসজিদে আসরের আজান হচ্ছে। মসজিদে গিয়ে নামায পড়ল। তারপর মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে সাড়ে পাঁচটার সময় চেয়ারম্যানের ঘরের সামনে এসে পৌঁছাল।
মহসিন ও তার বন্ধুরা সদর হাসপাতালে গেছে হাত পা প্লাস্টার করার জন্য। তখনও ফেরেনি। চেয়ারম্যানও পাশের গ্রামের মিটিং-এ চলে গেছেন।
রাহেলা ঘরের চাকর শাহাদতকে পাঁচটা থেকে বৈঠকখানায় বসে থাকতে বলে বলেছে, চরদৌলতখান গ্রাম থেকে একটা লোক আসবে। আসার পর তাকে বসতে বলে আমাকে খবর দিবি।
শাহাদতের বয়স চৌদ্দ পনেরর মতো। সে সকালের মারামারি দেখেছে। তাই শফি ও রবিউল যখন বেঠকখানার কাছে এল তখন শফিকে চিনতে পারল। ভাবল, ইনি সকালের দিকে মহসিন ভাই ও তার বন্ধুদের হাত পা ভেঙ্গে দিয়ে গেল, এখন আবার কেন এসেছে? মহসিন ভাই ও চাচা জানতে পারলে তো মেরে ফেলবে।