এমনি অস্বাভাবিক পরিবেশেই আমার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত লোকে’র শেষপর্ব লিখে শেষ করলাম। আম্মার পড়া হলে আব্বা চেয়ে নিলেন পড়তে। আমি দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করছি আব্বার মন্তব্য শুনতে। এবার উপন্যাসের কাহিনি চুম্বকটা বলছি–
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনি। স্নেহপ্রবণ আত্মকেন্দ্রিক বড়ো মেয়ে। বিয়ের বয়স হয়েছে অনেকদিন কিন্তু টাকা, রূপ আর মনমতো পাত্রের অভাবে বিয়ে হয়নি। আবেগপ্রবণ নায়ক। ছোট দুই বোন চঞ্চল প্রজাপতি, হাসি খুশি। বাবা নিরীহ মানুষ, হৃদয়ে তার অফুরন্ত স্নেহ অথচ তার খোঁজ রাখে না কেউ। বড়োলোকের খেয়ালি মেয়ে কিটকিকে ভালো লাগল নায়কের। ভালো লাগাটা একতরফা নায়কেরই। কিটকির সহজ ভদ্রতাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করল সে। শেষ অঙ্কে দেখা গেল বড়ো মেয়ে তার নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছে। ছেলেটি বিয়ে করেছে সহজ সাধারণ একটি মেয়েকে। বাবাও আজ সঙ্গীহীন। অথচ পৃথিবী তেমনি চলছে, চাঁদের নরোম জোছনা তেমনি ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীতে। অঝোর ধারায় নেমেছে বৃষ্টি। উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরা আজ নির্লিপ্ত স্মৃতিচারণে ব্যস্ত। সমস্ত পেয়েও আজ যেন কেউ কিছু পায়নি।
করুণ রসপ্রধান উপন্যাস। যেখানে রুনুর চরিত্রটা খুব দরদ দিয়েই লিখেছি। রুনু নায়কের ছোটোবোন। বাস্তব উপাদান নিয়ে এটা তৈরি করেছি বলে বেশ বাস্তবানুগও বটে। নিজের ধারণা খুব ভালোই হয়েছে। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি আব্বা কী বলেন। দেখলাম তিনি খুব উৎসাহ নিয়েই পড়ছেন। দুপুরে উপন্যাস হাতে অফিসে চলে গেলেন। পড়া শেষ হলে বললেন না কিছুই, শুধু শেফুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর দাদা ভাইয়ের বইটা পড়েছিস?
রাতে শুয়ে আমাকে ডাকলেন। বললেন, তোর উপন্যাস খুব মন দিয়েই পড়েছি। দুই এক জায়গায় একটু অসংলগ্ন হয়েছে… বলে দু একটা টেকনিকেল ত্রুটি দেখিয়ে দিলেন, তারপর বললেন, ‘বেশ হইছেরে, আমার খুব ভালো লেগেছে, রুনুর ডাইরির অংশটা পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে যায়। আমারও একটা উপন্যাস লেখার বহুদিনের সখ। তবে আমার ধৈর্য থাকে না আর সময়ই-বা কই!’
রাতে শুয়ে শুয়ে আব্বার কথাই ভাবছিলাম। সম্পূর্ণ নিজের পরিকল্পনায় তার একটা বই ছাপাব এবং সেটি ছাপায়, প্রচ্ছদে সব দিক থেকেই হবে অনবদ্য। অবশ্য এই ভাবনার পিছনে একটু কারণও ছিল। আব্বা তার সামান্য সঞ্চয় থেকেই একটি বই ছাপিয়েছিলেন। সেটি সেই কারণেই ছাপায়, প্রচ্ছদে, কাগজে খুব নিকৃষ্ট মানের হয়ে তার মনোবেদনার কারণ হয়েছিল। রচনা ভালো হওয়া সত্ত্বেও তা কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।
রহুল মামা বেড়াতে আসলেন এই সময়টাতে। হইচই আর আমোদ চরমে উঠল। সোনায় সোহাগার মতো নানাও এসে হাজির। তাদের আগমন উপলক্ষে পারিবারিক দেয়াল পত্রিকা সুনিলিত সাগরিত’ (পারিবারিক পত্রিকা, কারো জন্ম বা বিয়ে উপলক্ষে প্রকাশিত হয়। নামটি হুমায়ূন আহমেদের দেওয়া।) এর বিশেষ সাক্ষী বের করল এর সম্পাদিকা মমতাজ আহমেদ শিখু। সেও বহুদিন কুমিল্লায় থেকে এসেছে। কাজেই তার উৎসাহ প্রায় বল্গা ছাড়া। আমাদের খাঁটি আনন্দে কিছুটা ভেজাল মিশল। মামা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে রাগ করে খুলনা চলে গেলেন তার ভাইয়ের কাছে। আব্বা বললেন, ‘সবুর করো দেখবে দুদিন পর রহুল সেখান থেকে রাগ করে আবার এখানে এসে পড়বে।’
নানাও চলে গেলেন খুলনা; খুশি মনেই গেলেন। এদিকে ঝামেলা প্রায় মিটে গেছে। VOA থেকে বলা হলো শেখ মুজিব আর ইয়াহিয়ার ভেতর একটা আপোষ হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়েছেন। ইয়াহিয়া। আমার মন খারাপ হয়ে গেল আবার পরীক্ষা দিতে হবে ভেবে। শেফু, শিখু, ইকবালও মুখ কালো করে ঘুরতে লাগল সব ঠিক হয়ে যাবে আবার হোস্টেলের নিরানন্দ একঘেঁয়ে জীবন।
(২য় পর্ব সমাপ্ত)
ঝড় উঠল সত্যি সত্যি
ঝড় উঠল সত্যি সত্যি। অবরুদ্ধ জলতরঙ্গে বিক্ষোভ তৈরি করতে সৃষ্টি পরিকল্পনা সফল করতে এগিয়ে এলেন লে. জে. টিক্কা।
গভীর রাতে হইচই শুনে ঘুম ভাঙল। অফিসের টেলিফোন অনবরত বেজেই চলেছে। বাইরে বহু লোকের পদচারণা। মাইকের ঘোষণা–
‘মহাবিপদ, মহাবিপদ, সবাই আসুন থানার সামনে হাজির হোন। মহাবিপদ মহাবিপদ।’
আব্বা আগেই উঠেছেন। আম্মাও উঠেছেন। শেফু, ইকবাল, শিখুর ঘুমও ভেঙেছে। আমি আব্বা আর ইকবাল দৌড়ে চললাম থানায়। সঙ্গে আছে অফিসের পাংখাপুলার রশীদ, (পরবর্তীকালে পরিবারকে অনেক সাহায্য করেছে; একাত্তরের পরে আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।) রাত তখন দুইটা। থানার সামনে অনেকেই জড়ো হয়েছে। সবাই ভীত সন্ত্রস্ত কি জানি কি হলো। বেশ শীত করছিল। থানার o.c র সঙ্গে আলাপ করে আব্বা গেলেন wireless opgrpor-এর ঘরে। সেখান থেকে যখন বের হলেন তখন তাকে দেখে মনে হচ্ছিল একটা মরা মানুষ বের হয়েছে ক্লান্ত গলায় বললেন, wireless-এ খবর এসেছে মিলিটারিরা রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। খুলনায় তারা পুলিশ লাইন ঘিরে আছে। কুমিল্লার পুলিশ ওয়ারলেস dead, চিটাগাং এ তুমুল যুদ্ধ চলছে। কিন্তু কেন এটা হচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না।
চারিদিকে নানা জল্পনা। কেউ বলছে জেনারেল হামিদ ইয়াহিয়াকে গ্রেফতার করেছে। কেউ বলছে সৈন্যদের মধ্যে গণ্ডগোল লেগেছে। কেউ বলছে শেখ মুজিবকে গুলি করে মেরে ফেলেছে তাই এ ঝামেলা। আবার অনেকে বলছে আমেরিকার গ্রিন টুপ নেমেছে।