আব্বার গল্পের আসরে মাত্র দু-জন গল্প বলার সুযোগ পেত। একজন স্বেচ্ছায় বলতেন, অন্য জনকে নিয়ে জোর করে বলানো হতো। তারা হলো আম্মা আর ছোটো ভাই শাহীন। শাহীনের গল্প ছিল দুটো, আব্বা এই গল্পগুলো বারবার শুনতেন এবং প্রতিবারই সমান আনন্দ পেতেন। আমাদের কাছে একঘেয়ে লাগলেও আব্বার আনন্দ দেখে আমাদের ভালো লাগত। শাহীনের গল্পটি এই :
“আমার বন্ধু আজাদের খুব বুদ্ধি। ক্লাসে তাকে স্যার জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আযাদ কাল আসনি কেন?’ আযাদ উত্তরে একটা মস্ত গল্প শুরু করল—‘স্যার আমি পরশু বিকেলে আব্বার সঙ্গে গিয়েছিলাম মেলায় সেখানে শহীদের আব্বা একটা দোকান দিয়েছে। ঐযে স্যার ঐ কোণার দিকে। হলুদ শার্ট সে হলোশহীদ। আমার আব্বা। সেই দোকান থেকে আমাকে একটা মোটর গাড়ি কিনে দিয়েছেন। শাহীন দেখেছে সেই গাড়ি। ঐযে কোণার দিকে ও হলো শাহীন। তারপর স্যার সার্কাসের ভেতরই মউত কা কুয়া দেখলাম। মউত কা কুয়া হলো একটা কুয়া যার ভিতরে মোটর সাইকেল চালায়। ঐটা দেখে বাসায় আমি একটা মউত কা কুয়া বানিয়েছিলাম কাল সারাদিন সেইখানে আমার মোটরগাড়ি চালিয়েছিলাম। তাই আসতে পারি নাই।”
আম্মাও খুব ভালো গল্প করতে পারতেন। তাছাড়া চমৎকার অনুকরণও করতে পারতেন। তাঁর গল্প অবশ্য অধিকাংশই স্মৃতিচারণ। নিজের কথা, নিজের গ্রামের বন্ধুদের কথা, আমাদের ছোটোবেলার কথা, চমৎকার লাগে শুনে। তাঁর একটি চমৎকার স্মৃতি কথা লিখছি এইখানে, যাতে তাঁর স্মৃতির মিষ্টি দিকটা সুন্দর ফুটেছে।
“নতুন বিয়ে হয়েছে তখন। বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। অনেকদিন তোর আব্বার কোনো খবর নেই। মনটা কিছু বিক্ষিপ্ত। রাত তিনটার দিকে তোর নানু ডেকে তুললেন, ‘জামাই এসেছে।’ তোর আব্বা তখন এই প্রথম বারের মতো একটা গ্রামোফোন কিনে এনেছে। তাকে ঘিরে ফজলু, নজরুল (বড় মামা এবং মেজো মামা) এরা। হঠাৎ গান বেজে উঠল। আমার জীবনে প্রথম শোনা গ্রামোফোনের গান। আর সেকি চমৎকার গান–
‘..কোনো এক গাঁয়ের বধুর কথা তোমায়
শুনাই শোনো
রূপকথা নয় সে নয়…’
গভীর রাত, সবাই নিঝঝুম হয়ে গান শুনছে। কি যে ভাল লাগলো আমার।”
গল্পের আসরে আমার ভূমিকাটা প্রায়ই পড়ুয়ার। হাসির গল্প পড়ে শুনাননা। পড়ানোর বিরক্তিকর কাজটা আনন্দেই করতাম যখন দেখতাম এতে অন্যদের খারাপ লাগছে না।
একদিকে চলছে অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে আমাদের গতানুগতিক জীবনধারা। হাসি গান আর গল্পে ঠাসা সুখী জীবন।
এর মধ্যেই বাসায় একদিন জিন আনা হলো। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কিছুতেই বিশ্বাস করা চলে না। তবু সম্পূর্ণ হেসে উড়িয়ে দিতেও কিছু বাধা আছে। উদ্যোক্তা হলেন C.G. সাহেব। যে লোক জিন আনবে তাকে বরিশাল থেকে খবর পাঠিয়ে আনাননা হলো। আব্বার উৎসাহই সবচে বেশি। ঘর পরিষ্কার করে, গোলাপজলে ধুয়ে, দরজা-জানালা বন্ধ করে ভদ্রলোক আসন করে বসলেন বাতি নিভানো হলো। আমরা ভয়ে কাঠ হয়ে অপেক্ষা করছি। ভদ্রলোক কোরান আবৃত্তি করতে লাগলেন। আর সত্যি সত্যি জ্বিন এলো শেষ পর্যন্ত। কথা বার্তাও হলো। প্রথম ভাবলাম হয়ত ভেন্ট্রিলোকুইজম– যার সাধ্য এক জায়গা থেকে এমনভাবে কথা বলা যায়, যাতে মনে হয় ভিন্ন দিক থেকে কথা ভেসে আসছে। কিন্তু তবু রহস্য থেকেই যায় কারণ প্রায় সবসময়ই ভদ্রলোকের কোরান আবৃত্তি আর জিনের কথা বার্তা একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছিল। তাছাড়া এই জিনই o.c সাহেবের বাসায় রাগ হয়ে আড়াইমণি চালের বস্তা নিমিষের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছিল এবং o.c সাহেবকে বলেছিল যে তার হৃৎপিণ্ড একটু লম্বাটে ও ডিফেকটিভ (সঠিক তথ্য সেরকম প্রমাণ নেই)। বড়ো ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা Euctrocardiograph করে o.c সাহেব সত্যি তার হৃৎপিণ্ডের এই দোষ জানতে পেরেছিলেন।
জিনের সঙ্গে আমাদের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হলো :
আব্বা : আসসালামু আলায়কুম
জিন : অলায়কুম আসসালাম
আব্বা : জনাব, দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে আমরা সবাই খুব বিচলিত। শেষ পর্যন্ত কী হবে বলবেন দয়া করে?
জিন : আমরা তো অতি সাধারণ জীব, ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা আমাদের নাই। অতি সামান্য যা ক্ষমতা আছে তাতে বুঝি জয় হবে। আপনাদেরই। তবে সামনে বড়ো বিপদ, দেশের এবং অন্যান্য সবার। মহাবিপদ। হাত তুলে দোয়া করি।
(দোয়া চলল)
আমি : আপনারা কোথায় থাকেন বলবেন কি?
জিন : কোহকাফ নগর।
আমি : মানুষ যে চাঁদে গিয়েছে তা বিশ্বাস করেন?
জিন : কিছুক্ষণ চুপচাপ। গিয়েছে নাকি?
আব্বা : জিনদের সম্বন্ধে আমার অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা হয়, আপনি জানাবেন কি?
জিন : এই সম্বন্ধে পরে আলাপ করব। আপনি নির্জনে আমার কথা চিন্তা করবেন। আমি আসব।
দেশের রাজনৈতিক পট আবার পরিবর্তিত হলো। সমস্ত ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত দেশবরেণ্য নেতা শেখ মুজিবের হাতে। দৌড়ে এল ইয়াহিয়া। সকাল-বিকাল শেখ সাহেবের সঙ্গে সুদীর্ঘ মিটিং। আশার আলো দেখতে পেল সবাই। ইয়াহিয়া-শেখ মুজিব আলোচনার অগ্রগতি খবরের কাগজে হেডিং বেরুল। দু-জনের হাসিহাসি মুখের ছবিও ছাপা হলো বিভিন্ন কাগজে।
আব্বা ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠছিলেন। সারাটা দিন কাটাতেন খবর শুনে। অনিশ্চয়তা তার বুকে পাথরের মতো চেপে বসছে। কাজ ছাড়া যে-মানুষ একদণ্ড থাকতে পারে না তার জন্য কর্মশূন্য এমন জটিল পরিস্থিতি অস্বস্তিকরই বটে।