এদিকে সময় আর কাটে না। সময় কাটানোর জন্যেই একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম। অসফল প্রেমের ওপর ভিত্তি করে নিতান্তই সহজ-সরল উপন্যাস। মহৎ আদর্শ কিছু নেই, সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতির কোনো সমস্যাও নেই। লিখতে লিখতে দেখলাম পরিচিত সব চরিত্র কলমে উঠে আসছে। উপন্যাসে বাবার চরিত্র হয়ে উঠল আমার আব্বার চরিত্রেরই অনুলিপি। নায়কতো নিজেই, নায়িকারাও খুব একটা কল্পনার নয় সময় কাটতে লাগল হু হু করে। ছোটোবোনের নামে দু-একটা কবিতাও লিখে পাঠালাম দৈনিক পাকিস্তানে। ছাপাও হলো। অসমাপ্ত পরীক্ষা, দেশের পরিস্থিতি সমস্তই আমার মন থেকে মুছে গেল। ঘাড় গোজ করে অনবরত লিখে চলেছি। এক-একটা পরিচ্ছেদ শেষ হয়, সবাইকে পড়ে শুনাই। চলবে, মন্দ নয় এই জাতীয় মন্তব্যে উৎসাহেও ভাটা পড়ে না।
আব্বাও কিছুটা বিশ্রাম পেলেন। মফস্বলে মফস্বলে ঘোরাটা বন্ধ হলো। কাজের মধ্যে সকালে ঘুম থেকে উঠে খবর শোনা, অফিসের কাগজপত্র দেখতে দেখতে চা খাওয়া, মাঝে মাঝে Court-এ যাওয়া, দুপুরের দিকে অল্পকিছু খেয়ে একটু ঘুম। বিকেলে বারান্দায় চেয়ার পাতা হতো। প্রাত্যহিক বৈকালিক আসরের নিয়মিত সদস্য ছিলেন ডাক্তার সাহেব, কোর্ট ইন্সপেকটর সাহেব, SDPRO সাহেব। ঘনঘন চা পাঠানো হতো। আব্বা মেজাজি মানুষ, মেজাজে থাকলে ভালো গল্প। করতে পারতেন, গল্প করতে ভালোও বাসতেন। তাঁর আসল উৎসাহ ছিল occultstudy-তে কাজেই সবরকম রাজনৈতিক আলোচনা শেষ হতো ভূত, প্রেত, জ্বিন, পামিস্ট্রি আর এসট্রোনমিতে এসে। এই আসরে রাজনৈতিক নেতারাও আসতেন। ন্যাপ মনোনীত প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী আলী হায়দার খান (পরবর্তীকালে বোন সুফিয়া হায়দারের স্বামী) তাদের মধ্যে অন্যতম। সে আব্বার বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিল। অনেক ব্যাপারেই আব্বা তার ওপর নির্ভর করতেন। আব্বার রাতটা কাটত SDO সাহেবের (নাম মহিবুল্লাহ শাহ। বাড়ি সম্ভবত বেলুচিস্তান) বাসায়। ভদ্রলোকের বাড়ি সিন্ধু। আব্বার সঙ্গে তার কোনোই মিল ছিল না। না চরিত্রে, না বয়সে বা স্বভাবে কিন্তু মিল ছিল আত্মিক। ‘সিন্ধ থেকে চিঠি লিখেছে ছোটো ভাই আপনি যদি আসতেন তবে পড়ে শুনাতাম।’ ‘বহুদিন চিঠি পত্র পাই না, মন বড় খারাপ, আপনি যদি আসেন তবে মনটা একটু হালকা হয়।’ ‘সুন্দরবন দেখতে যাব আমরা কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি বন্ধুও এসেছেন, আপনি যদি সঙ্গে আসেন।’ এই জাতীয় Telephone আসত প্রায়ই।
বেচারা একা একা থাকে; রবীন্দ্র সংগীতের এক পাঁজা রেকর্ড দিয়ে আসলেন আব্বা। রবীন্দ্রসংগীতের অর্থ বুঝতে পারছেন না নিজেই গানগুলোর ভাবো অনুবাদ করে দিলেন। পিরোজপুরে ভালো দুধ পাওয়া যাচ্ছে না, বাসা থেকে একসের একসের দুধ পাঠাতে লাগলেন।
আগেই বলেছি আমাদের সময় খুব ভালো কাটছিল। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, খুব হইচই করে দিন কাটছিল! স্বাভাবিক যেমন কাটে তেমনি। সন্ধ্যার পর বেড়াতে যেতাম সবাই মিলে। বাসার ডানপাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা হুলারহাট পর্যন্ত গিয়েছে সেই রাস্তা ধরে হাঁটতাম। টি.বি. হসপিটাল, টাউন কমিটি পেরিয়েও অনেক দূর যাওয়া হতো দুপাশেই বিস্তীর্ণ মাঠ, দূরে রেখার মতো অস্পষ্ট গ্রাম, অসংখ্য নারিকেলের শাখা বাতাস লেগে কাঁপছে, অপূর্ব লাগত। এক রাতের কথা খুব মনে পড়ে। আটটার দিকে বেড়াতে বেরিয়েছি, হিন্দুপাড়ার ভিতর দিয়ে রাস্তাটা গিয়েছে। চাঁদ উঠেছে; খুব নরম জোছনা। হাঁটছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম হিন্দুপাড়ায় গান হচ্ছে। উঠোনে পাটি বিছিয়ে বসেছে সবাই–
‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে
ফুল ডোরে বাঁধা ঝুলনা।’
চমৎকার লাগছিল। আম্মা তাড়া দিচ্ছিলেন—‘কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শোনা। কিন্তু শেফুর খুব ভালো লাগছিল তার জোরাজুরিতেই সম্পূর্ণ গানটি শুনলাম। এরপর যত রাতে ঐ বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়েছি ততবার মনে মনে গান শুনব প্রতীক্ষা করেছি। আর শোনা যায়নি।
যখন বেড়ানো শেষ করে ফিরে আসতাম দূর থেকেই আমাদের বাসাটা নজরে পড়ত। পুরানো আমলের নকশাকাটা হলুদ দালান ভেতরে টিউব লাইটের নীল আলো জ্বলছে। সামনের পুকুরে একটা নীলচে পরিষ্কার প্রতিবিম্ব পড়েছে। নিজেরা বলাবলি করতাম পিরোজপুরের তাজমহল যমুনার জলে প্রতিবিম্বিত হয়েছে।
মাঝে মাঝে হতো নৌকা ভ্রমণ। প্রকাণ্ড সরকারি নৌকায় শুয়ে বসে বেড়ানো। গান বাজছে টেপ রেকর্ডে কিংবা গাইছে শেফু, শিখু। মাঝিরা চায়ের জল চড়িয়েছে। নৌকা চলছে মন্থর গতিতে। নদীর জল আয়নার মতো ঝক ঝক করছে, দূরে ছবির মতো সুন্দর সবুজ গ্রাম, সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে, নদীর পানি গাঢ় হলুদবর্ণ ধারণ করেছে, গাছের পাতা শেষের রোদ লেগে সোনার মতো জ্বলছে। মনটা উদাস হয়ে উঠত।
গল্পের আসরগুলো হতো ভারি মজার। প্রধান বক্তা আমি, তারপরই বলতেন আম্মা। আব্বা এই আসরে প্রায়ই থাকতেন না। যেদিন থাকতেন সেদিন বলতেন শুধু তিনিই, আমাদের শোনার পালা। কয়েকটি গল্প ছিল তার খুবই প্রিয়। এগুলো সবসময়ই বলতেন। তার বলার কায়দায় কোনোদিন সেগুলো পুরোনো মনে হতো না। একটি গল্প এই ধরনের
আমি তখন কলকাতায় কেশব দাস স্ট্রিটের এক মেসে থাকি। সঙ্গে আছেন দুদু মিয়া (সম্পর্কে নানা)। একদিন এক বইয়ে পড়লাম কালো মশারিতে খুব সুনিদ্রা হয়। কই পাই কালো মশারি? রং করে সেই সমস্যার সমাধান হলো। একদিন বিকেলে মেসে এসে দেখি মশারিও নেই, দুদু মিয়াও নেই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। দুদু মিয়ার দেখা নেই। পরে শুনলাম সে গিয়েছে হক সাহেবকে কালো নিশান দেখাতে। কালো নিশান এত তাড়াতাড়ি করে কোথায় পাবে। মশারিটাই নিয়ে গিয়ে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।