কেবিনের পাশে হাঁটার রাস্তায় একটা চাদর বিছিয়ে ফেলা গেল। আমরা দুভাই কোনো মতে এঁটে বসলাম সেখানে। মেয়েদের বসার সমাধানও হয়ে গেল ভালোভাবেই। কেবিনে-বসা ভদ্রলোকেরা উৎসাহিত হয়েই মেয়েদের তাদের কেবিনে ডাকল। এরাতো আর গ্রামের জবুথবু লাজুক মেয়ে নয় যে, ছেলেদের কেবিনে ডেকেছে বলে লজ্জায় পড়ে যাবে। ইউনিভার্সিটির ঝকঝকে মেয়ে হাসতে হাসতেই কেবিনে ঢুকে পড়ল। সেখানে আরো দু-জন এই উপায়েই কেবিনে আশ্রয় নিয়েছিল। কাজে কাজেই গল্প, তর্ক, হাসাহাসি শুরু হলো। ঘন ঘন চা আর বিসকুট আসতে লাগল। বলাবাহুল্য ভদ্রলোকরা উদার হস্তে খরচ করতে লাগলেন এবং মেয়েদের অতি সামান্য রসিকতায় হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন।
আমি বাইরে বসে এদের গল্প শুনছি। আলাপের ধারা গড়াতে গড়াতে শাড়ি-গয়না সেখান থেকে সোনার দাম, সোনার দাম থেকে দেশের অবস্থা, দেশের অবস্থা থেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার একটি গল্প চমৎকার লাগল। গল্পটির কথক ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয় সে ইউনিভার্সিটির সেই ধরনের মেয়ে University-তে পড়াটা যাদের কাছে। একটা দামি-গয়না। গয়না যেমন রূপ লাবণ্য বৃদ্ধি করে বলে ধারণা, Universityর ছাত্রী এই ছাপটা তেমনি মেয়েদের মধ্যে একটা আলাদা সৌন্দর্য এনে দেয় বলে এদের ধারণা। যাদের আসল গায়ের রং বাদামি প্রলেপের আড়ালে নিজেদের কাছে পর্যন্ত আচ্ছন্ন। ছেলেদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিতে যারা ভীষণ উৎসাহী; উৎসাহটা অবশ্য নিজেকে বিজ্ঞাপিত করার জন্যে যে, দেখো আমরা কেমন প্রগতিবাদী, কেমন অনায়াসে ছেলেদের সঙ্গে মিশছি। গল্পটি এই রূপ:
যারা মিলিটারির গত কিছু দিনের ইতস্তত গুলি বর্ষণে আহত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অভিমত নেবার জন্যে রোকেয়া হলের কয়েকজন মেয়ে মিলে হাসপাতালে গেল। সেখানে অনেক বুলেটবিদ্ধই পড়ে আছে। মেয়েরা প্রত্যেকের কাছেই যাচ্ছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে এবং বলছে তাদের খাতায় কিছু একটা লিখে দিতে। কেউ দিচ্ছে কেউ-বা জানাচ্ছে, আমি লিখতে জানি না। যাই হোক সহযাত্রী মেয়েটি তার খাতা নিয়ে একটি ছেলের কাছে দাঁড়াল। দেখেই মনে হচ্ছে ছেলেটি শিক্ষিত হয়ত কোনো কলেজের বা স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র। গলা পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা।
‘দিন না আমার খাতায় কিছু লিখে। কেন আপনি মিছিলে এসেছিলেন, কি করে গুলি লাগল এই সব।’ ছেলেটি কোনো কথা বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে। আবার অনুরোধ করে, দিন না একটা কিছু লিখে ছেলেটি তবুও নীরব। এমন সময় নার্স আসে বৈকালিক আহার নিয়ে। টান দিয়ে চাদরটি সরাতেই দেখা। যায় ছেলেটির ডান হাত কজি পর্যন্ত কেটে বাদ দেয়া হয়েছে সেখানে। নিপুণ ব্যান্ডেজ। দুঃখ ও লজ্জায় মেয়েটি পালিয়ে আসে।
গল্পে গল্পে রাত হয়ে গেল। দূরে চাঁদপুরের আলো দেখা যাচ্ছে। চাঁদপুর যাত্রী মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও উদ্বিগ্ন হলাম। সমস্যাটি মিটল হঠাৎ করেই। লঞ্চেই ইকবালের বন্ধু কবি বলাকা মুখার্জির সঙ্গে দেখা। সে যাচ্ছে কুমিল্লা ভায়া চাঁদপুর। কিন্তু যখন তাকে মেয়েটির সামনে হাজির করা হলো এবং বলা হলো কোনো ভয় নেই সে আপনাকে চাঁদপুরে বাসায় রেখে তারপর যাবে। মেয়েটির মুখ কিন্তু আনন্দে উদ্ভাসিত হওয়ার বদলে আরো যেন আমশি মেরে গেল। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, ছেলেটির বাড়ি কোথায়, কোথায় যাবে, কী পড়ে। ভালো করে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে মেয়েটির উদ্বেগের সঙ্গে ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম। তার চেহারায় কবি সুলভ নির্লিপ্ততার বদলে নাট্যকার সুলভ ক্ষিপ্ততার ছাপটাই প্রবল। ছোটো চোখ, পাতলা ঠোঁট, কিঞ্চিৎ ঝুলন্ত নাক–সব মিলিয়ে এমন একটি ধারণা হয় যে, এইমাত্র কিছু একটা অন্যায় করে পুলিশের ভয়ে আত্মগোপন করে। আছে। যাই হোক বলাকা মেয়েটিকে নিয়ে নেমে গেল। আমরা হুলারহাটে পৌঁছলাম ভোর পাঁচটায়। সেখানে শুনি শেখ মুজিবের আহ্বানে যানবাহনে হরতাল চলছে।
খুশি মনেই হাঁটতে হাঁটতে বাসায় পৌঁছলাম। সদর দরজা খোলা। ঢুকে দেখি দুটি পালঙ্ক একত্রে করে মস্ত বিছানা তৈরি করে সবাই শুয়ে। আব্বা সাধারণত দেরিতে ওঠেন। সেদিন যেন আমাদের জন্যেই ঘুম ভেঙেছে সকালে। সবাইকে দেখে ছেলে মানুষের মতো। খুশি হয়ে উঠলেন
আরে দেখো কে এসেছে, এই ওঠো না। আম্মা উঠলেন। আব্বা সিগারেট ধরিয়ে খুশি সরে ঢাকার কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। একটু পরে পরেই বলতে লাগলেন ‘যাক সবাই এসে গেছে, হাজার শুকুর। আর ভয় নাই। আর ভয় নাই।’ আব্বা তার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী চড়া ভল্যুমে রেডিও ছেড়ে দিলেন। শেফু যখন আব্বা। আম্মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল তখন আনন্দে আব্বার চোখে পানি এসে গিয়েছে।
(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
আগুনের মতো ভাষণ হলো শেখ সাহেবের
৭ তারিখে আগুনের মতো ভাষণ হলো শেখ সাহেবের। তার সেই বিখ্যাত চার দফা পূর্বশর্তের অপূর্ব ভাষণ :
‘…আমি যদি তোমাদের কাছে না
থাকি তোমাদের উপর আমার আদেশ
রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের
যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও, রক্ত
যখন দিতে শিখেছি আরো দেব। বাংলাকে
মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহু…’
কাউকে ভয় দেখাতে হলো না, জোর করতে হলো না বন্ধ হয়ে গেল স্কুল-কলেজ কোর্ট-কাছারি। সরকাপ্পি বেসরকারি সমস্ত অফিসেই। তালা ঝুলল। শুধুমাত্র শেখ সাহেবের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে। সবাই বুঝতে পারছে ঝড় আসছে। বহুদিনের সঞ্চিত সমুদ্রের বিশাল জলরাশি ফুলে উঠছে। বাঁধ দিয়ে এ ঠেকানো যাবে না।