‘শুনলাম আপনি পরীক্ষা না দিয়েই চলে যাচ্ছেন?’
মুখে হাসি টেনে আমি বললাম, ‘হ্যাঁ কোত্থেকে শুনলেন?’
‘আপনার বোনের কাছ থেকে। আচ্ছা আপনিও বরিশালে যাবেন?’
‘হ্যাঁ পিরোজপুরে।’
‘আমি কুষ্টিয়া যাব। এদিকে রেল আবার বন্ধ। অবশ্য যশোহর থেকে বাসে যাওয়া যায় খুলনা থেকে যশোহর পর্যন্ত বাসসার্ভিস আছে। আচ্ছা পিরোজপুর থেকে খুলনা কতদূর?’
‘বেশি দূর না, কাছেই।’
আচ্ছা আমি যদি আপনাদের সঙ্গে যাই আপনাদের অসুবিধা হবে? খুলনা পর্যন্ত যেতে পারলেই হবে, খুলনায় আমার এক খালু থাকেন।
আমি আমতা আমতা করি—
‘আমি সেইদিনই চলে যাব। শুধু একজন লোক দেবেন খুলনা পর্যন্ত।’
‘বেশত আসেন আসেন?’
‘আর মনে করেন রাস্তায় কোনো অসুবিধা হলো যাতে আমার পিরোজপুরে দুই একদিন থাকা লাগে।’
‘না অসুবিধা হবে না কিছু?’
অপরিচিত মেয়ে দেখে আম্মা হয়ত বা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাতে পারেন কিন্তু আদর যত্ন কম হবে না বরংচ একটু বেশিই হবে। তবে বাসা ছোটো এই একমাত্র অসুবিধা আমাদের নিজেদেরই কুলোয় না। ঠিক হলো সে পরদিন ভোরে আমাদের সঙ্গেই যাবে। শেফুর রুম নাম্বার জানত না সেটি জানিয়ে দিলাম।
বাসায় রওনা হবার আগে পরীক্ষার্থী ৪/৫ জন মিলে গেলাম Head of the department (রসায়ন বিভাগীয় অধ্যাপক মোকাররম হোসেন) এর সঙ্গে দেখা করতে। স্যার বেরিয়ে এলেন। কাঁদ-কাঁদ মুখ উদ্ভ্রান্ত চেহারা। বসতে বললেন। সংকুচিত ভাবেই বসলাম। স্যার করুণ কণ্ঠে বললেন— ‘শুনেছ বোধ হয় তোমাদের Department থেকে বহু দামি chemicals কাল রাতে একদল ছেলে ডাকাতি করে নিয়ে গিয়েছে।’ ঘটনাটা জানতাম না কাজেই বিস্মিত হলাম।
‘chemicals নিয়ে ওরা কী করবে স্যার?’
যা যা নিয়েছে তা দেখে মনে হয় হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা তৈরি করবে। তবে সঙ্গে আরো সব দামি দামি chemicals নিয়েছে যার কোনো দরকারই হবে না। আমার এত কষ্টে জোগাড় করা chemicals—স্যারের মুখ করুণ হয়ে উঠল। অস্পষ্ট ভাবে বললেন, কিছু একটা হবে। আমার মেয়ে একটা পশ্চিম পাকিস্তানে হ্যাসবেন্ডের কাছে আছে। সব সময় ভয়ে ভয়ে আছি।
আমরা পরীক্ষার কথাতে আসতেই বললেন—নিরাপদ জায়গায় যেতে চাচ্ছ, যাও। সব ঠিক না হলে পরীক্ষা হবে না। পরীক্ষার জন্যে ভেব না। কথা শুনে মনে হলো তিনি ঝুলছেন বড়ো কোনো ভাবনা ভাবো। আমরা বেরিয়ে আসলাম। স্যার হাঁটতে হাঁটতে গেট পর্যন্ত আসলেন। কী ভাবছিলেন তিনি, কে বলবে।
চারিদিকে তখন আলোচনার বিষয়বস্তু একটি–শেখ সাহেব ৭ তারিখে রেসকোর্সে ভাষণ দেবেন। না-জানি কী দেন না-জানি কী বলেন। উৎকণ্ঠায় শহর ঝিমিয়ে। খবরের কাগজগুলি আগুনের মতো তেতে আছে। এদিকে সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে এলেন। Lt. gen. টিক্কা। ঈদগার মাঠে বোমাবর্ষণ করে যিনি ইতিমধ্যেই বিভীষিকার নায়ক হয়ে রয়েছেন। ছাত্ররা যেন উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাবে। এদিকে বাঙালি বিহারি একটা ঝামেলা প্রায় পেকে উঠছে। শেখ সাহেব ধমক দিলেন–
‘ভাষা যাই হোক, বাংলাদেশে যে-ই বাস
করবে সেই বাঙালি। তাদের জান-মাল
আমাদের কাছে এক পবিত্র আমানত।’
ঝামেলাটা থেমে গেল বটে কিন্তু বিহারিরা ফুঁসতে লাগল।
ঢাকা থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্যে আমি অস্থির হয়ে উঠছি। বাসা থেকে কোনো খবর নেই। শেফু মেয়ে, নতুন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে— এদিকে ঢাকায় গণ্ডগোল। শুধু আমরা তিনজনই নই, মেজে বোন শিখু (মেজো বোন মমতাজ শহীদ) কুমিল্লায়। ফরিদা বিদ্যায়তনের হেডমিসট্রেস-এর বাসায় থেকে পড়াশুনা করছে। এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি। তার জন্যেও চিন্তা। শিখুর সঙ্গে কথা বলার জন্যে গেয়ে Telephone exchange এ। সে যেখানে আছে সেখানে Telephone নেই তবে কাছেই তার বান্ধবীর বাসা। সৌভাগ্যক্রমে প্রদির টেলিফোন নাম্বার জানা ছিল। গিয়ে দেখি ভো ভো Telephone exchange খালি। সমস্তই বন্ধ। অথচ essential service হিসেবে এটা খোলা থাকার কথা।
বেলা দুটোর দিকে হলের সামনে আমি আর ইকবাল রিকশা নিয়ে দাঁড়ালাম। ইকবাল গেল শেফুর খোঁজে। গিয়েছে তো গিয়েছেই, শেফুর দেখা নেই। পাঁচ মিনিট দশ মিনিট করে আধঘণ্টা পার হলো। অথচ লঞ্চ ছাড়বে গোটা চারেকের দিকে। যখন ধৈর্য্যের বাঁধ প্রায় ভেঙে পড়ছে তখন দেখা গেল শেফু হাসতে হাসতে আসছে, গেট পর্যন্ত এসেই বিদায়, কোনো কথা না বলেই। রাগে যখন মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। তখন সে নেমে এলো সঙ্গে তিনটি মেয়ে। তারা তিনজনই চাঁদপুর যাবে। বাসা লঞ্চঘাট থেকে আধমাইল, তারা তিনজন যাবে কাজেই ভয়ের কিছু নেই। আল্লাহর দয়া, ছাগীর দেখা নেই। জিজ্ঞেস করলাম ‘কিরে শেফু আমাদের ক্লাসের কারো সঙ্গে দেখা হয়েছিল?’
‘হুঁ।’
‘কিছু বলেছিল?’
না।
টার্মিনেলে পৌঁছে দেখি লঞ্চ এই ছাড়েতো এই ছাড়ে। তাড়াহুড়া করে উঠলাম। তিল ধারণের জায়গা নেই। ছেলেরা তবু না হয় কোনোমতে গেল কিন্তু মেয়েরা? সবাই পালাচ্ছে ঢাকা থেকে। শেফু কাঁদো কাঁদো হয়ে হঠাৎ বলল, ‘আর দুটি মেয়ে কই?’ সত্যিতো ইতিউতি করে খুঁজি চারিদিক। ধু-ধু করছে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। ‘আমি, আমি একা কি করে বাসায় যাব’ সঙ্গী মেয়েটি কেঁদে ফেলে আর কি। সত্যিতো রাত এগারোটায় পৌঁছবে চাঁদপুর, এই মেয়ে একা একা কী করবে। সিটি বাজিয়ে লঞ্চ ছেড়ে দিলো। শেফু অভয় দিলো ‘আপা আমাদের বাসায় চলেন। সেখান থেকে লোক দিয়ে আপনাকে পাঠাব।’