কি রে ভাল?
হ্যাঁ।
চল বাসায় চলে যাই।
না।
রাতে গুলির শব্দ শুনে ভয় লাগে?
উঁহু মজা লাগে।
আচ্ছা তা হলে যাই।
আচ্ছা।
আহসান খবর দিলো আর্ন উল্লাহ হলের তিনজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছে লামা থাকতেন আহসান উল্লায়। দু-জন একই হোস্টেলের রুমমেট হিসেবে দু-বছর কাটানোয় সম্পর্কটা ছিল। বন্ধুসুলভ। দু-জনেই সস্তা ধরনের রসিকতা উৎসাহের সঙ্গে নিঃসংকোচেই বলাবলি করতাম। অবশ্য মাঝে মাঝে তিনি যে মামা এটি তার মনে পড়ে যেত। অভিভাবকসুলভ গাম্ভীর্যে খোঁজ-খবর নিতেন আমাদের। ছাত্র গ্রেফতারের কথা শুনেই মনে হলো তিনজনের একজন মামা রুহুল আমিন (মামা এবং সহপাঠী) নয়তো! তিনটার দিকে খোঁজ নিতে বেরুলাম। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি সত্যি যদি তাই হয় তবে উত্তেজনার একটা খোরাক পাওয়া যায়। ফলাও করে গল্প করতে পারি। মামার গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। তার স্বভাব অনেকটা সেই জাতীয় বৈষ্ণবদের মতো যারা মুরগি খায় এবং নিজেদের এই বলে প্রবোধ দেয় যে গঙ্গাজলে বেঁধেছি কাজেই কোনো দোষ নেই। তিনি কোনো রাজনৈতিক মতবাদে জড়িত নন। অথচ একটি রাজনৈতিক সংস্থা থেকে ইলেকশন করে হলো সংসদের মেম্বার। মিছিল-টিছিল সমর্থন করেন না অথচ সব মিছিলের মাঝামাঝি থাকেন যাতে সামনে এবং পিছনে যে-কোনো দিক থেকেই বিপদ আসলে পগার পার হতে পারেন। অথচ দেখা গিয়েছে এই জাতীয় লোকগুলোই সবার আগে বিপদে পড়ে। সযতনে সমস্ত ঝামেলা এড়িয়ে তীরে এসে তরী ডোবায়।
গিয়ে দেখি মামা উপুড় হয়ে শুয়ে ঘরোয়া পড়ছেন। আশাভঙ্গ হলো। উঠে বসে আমার দিকে চেয়ে বলল ‘চল চা খেতে খেতে আলাপ হবে।’ চায়ে চুমুক দিতে দিতে মামা বললেন, কাল আমার ওপর দিয়ে বড় বিপদ গেছে। মিলিটারির তাড়া খেয়ে কম করে হলেও দেড় মাইল দৌড়েছি। রাস্তায় ইটের বাড়ি লেগে দেখ নখের অবস্থা।
হলে ফিরে এসে শুনি শহরে হঠাৎ করে curfew দেয়া হয়েছে। ঘণ্টাখানেক পরই নিউ মাকের্ট আর আজিমপুরের দিক থেকে গুলির শব্দ শোনা যেতে লাগল। অথচ ইকবাল এখনো ফেরেনি। হলের গেট বন্ধ করে দেওয়া হলো। ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে হলের ভিতরই ঘোরাফেরা করতে লাগল। সন্ধ্যা হলো, রাস্তাঘাট যা নজরে পড়ে তা জনমানবহীন। হলের মেইন সুইচ অফ করে দেয়া হলো। আলোতে হলের লবিতে দাঁড়ানো ছেলেদের দূর থেকে দেখতে পেয়ে যদি গুলি ছুঁড়ে এই ভয়ে। আমি ইকবালের জন্যে উদ্বিগ্ন বোধ করছিলাম। একবার ভাবি তার বন্ধু খাজার কাছেই আছে হয়ত। আরেকবার ভাবি হয়ত মামার কাছে গিয়ে আটকা পড়েছে। রেডিওর খবর শুনতে গেলাম নিচে। গুলির শব্দ এবার খুব কাছেই শোনা গেল। দমকলের গাড়িগুলো ঢং ঢং করে ঘণ্টা পিটতে পিটতে যাচ্ছে। Ambulance এর গাড়িগুলো যাচ্ছে তারস্বরে সাইরেন বাজাতে বাজাতে। একটি ছেলে হঠাৎ বলে উঠল কার্ফিউ দিয়ে মেয়েদের হলে যদি মিলিটারি ঢুকে পড়ে তবে কিন্তু করার কিছু নেই। শেফুর কথা মনে হতেই ধুকটা ধ্বক করে উঠল। সত্যি তো গত আন্দোলনে এমনি দু-একটা ঘটনা ঘটেছিল। কার্ফিউ আওয়ারে মিলিটারি অনেক ভদ্র বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়েছিল। উৎকণ্ঠায় পাথর হয়ে নিজের ঘরে এসে দেখি ইকবাল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। আছে। চাবি সঙ্গে না থাকায় ভিতরে ঢুকতে পারছে না।
‘কার্ফিউর ভিতর আসলি কী করে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।
‘আমি কার্ফিউর আগেই এসেছি। নিচে মামুনের (মো. মামুন, পরবর্তীকালে অর্থনীতির অধ্যাপক) সঙ্গে গল্প করছিলাম।’
দুঃশ্চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে অডহাউসের Pig have wing পড়তে লাগলাম মোমবাতি জ্বালিয়ে। পাশের রুমে বাজি রেখে কনটাক্ট ব্রিজ খেলা হচ্ছিল তার হইচই আর নিচ থেকে উত্তেজিত রাজনৈতিক আলোচনার আওয়াজেও আমার পাঠে বিঘ্ন হলো না।
রাত বারোটার দিকে নিচে প্রবল উত্তেজনার আভাস পেলাম। হইচই ভীত সন্ত্রস্ত্র দৌড়াদৌড়ি, ডাক্তার ডাক্তার চিঙ্কার। আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসি। বারেন্দায় নানাজি নজরুল ইসলামের (দূর সম্পর্কের নানা, একজন মুক্তিযোদ্ধা) সঙ্গে দেখা।
‘আরে তুমি, নিচে যাও দেখ গিয়ে কাণ্ড’ দৌড়ে নিচে গিয়েতো আমি হতভম্ব। দু-জন লোককে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে, রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। অ্যামবুলেন্সের জন্য ছেলেরা পাগলের মতো টেলিফোন করছে। খবরে জানতে পারলাম এরা একজন চিটাগাং রেস্টুরেন্টের বয় অন্যজন রিকশাওয়ালা। কার্ফিউ ব্রেক করতে গিয়ে একজন বুকে অন্যজন পায়ে গুলি খেয়েছে। যারা তাদের বয়ে এনেছে তারা ইউনিভার্সিটিরই ছাত্র। অ্যামবুলেন্স এলো অনেক পর, লোক দু-টিকে নিয়ে চলে গেল সাইরেন বাজাতে বাজাতে।
কার্ফিউ ভাঙল ভোর ৯টায়। দৌড়ে গেলাম রোকেয়া হলে। সেখানে গেটের কাছে খুব ভীড়। সবাই এসেছে আত্মীয় স্বজনের খোঁজে। হল থেকে পরিচিতদের সরিয়ে নিতে। মেয়েরা বিবর্ণ মুখে হল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। দেখলাম শেফুর অবিচল সাহসেও চিড় ধরেছে। সে নিজ থেকেই বলল, চল বাসায় চলে যাই। ঠিক হলো পরদিন বিকেলে ঢাকা ছাড়ব। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন মেয়ে যাবে। তাদের সঙ্গে কোনো অভিভাবক নেই। তারা চাঁদপুর নেমে যাবে।
সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বাসা থেকে টাকা নিয়ে কেউ আসে নি। নিজেদের সঞ্চিত পুঁজিও শেষ। আমি জিনিসপত্র গোছগাছ করছি বেয়ারা এসে খবর দিলো নিচে আপনার একজন গেস্ট এসেছে, মেয়ে গেস্ট। শেফু ছাড়া কে আর হবে। নিচে নেমে দেখি আমার ক্লাসমেট ‘ছাগী’ (প্রকৃত পরিচয় জানা যায়নি)। তার ‘ছাগী’ নামটির একটু ইতিহাস আছে। ছাগল যেমন যা পায় তাই চিবিয়ে দেখে। শুকনো চটিজুতা থেকে অঙ্ক বই সবই তার কাছে সমান প্রিয়। এই মেয়েটির স্বভাব তেমনি। সে যে কোনো ছুঁতোয় যে কোনো ছেলের সঙ্গে আলাপ করবেই। মেয়েদের সঙ্গে তার কোনো খাতির নেই তার যত উৎসাহ ছেলেদের নিয়ে। আমাদের ক্লাসের নিতান্ত ভ্যাবাগঙ্গারাম ছেলে সফিক যেদিন নতুন টেট্রনের শার্ট পরে এসেছিল সেদিন মেয়েটি তার শার্টে হাত দিয়ে কাপড় পরীক্ষা করতে করতে জিজ্ঞেস করেছিল কি টেট্রন পাকিস্তানি না জাপানি? আমরা ছেলেরা সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতাম। বিশেষ করে আমি, কারণ জনপ্রিয় ছাগী নামটি আমারই দেয়া এবং ভদ্রমহিলাও এটি ভালো করে জানেন।