মুহম্মদ জাফর ইকবাল
সবখানে একটা ঝড়ের আভাস
সবখানে একটা ঝড়ের আভাস দেখছিলাম। হলের ছেলেরা বইপত্র নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছিল। রাস্তাঘাটে লোকজন চলছে, অথচ যানবাহন নেই। এখানে-সেখানে ব্যারিকেড সাজিয়ে সকলেই কিছু একটার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমার ভালো লাগছিল না। সকলের হাবভাব, রাজনৈতিক-পরিস্থিতি ইত্যাদি দেখে আমি বেশ শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। ছোটো ভাইবোন দুটিকে নিয়ে বাসায় চলে যেতে চাচ্ছিলাম। অথচ ওরা দু-জনেই স্বভাবে আর মানসিক গঠনে আমার উলটো। যখন রোকেয়া হলে শেফুর (হুমায়ূন আহমেদের বোন সুফিয়া হায়দার) সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন তার উল্লসিত ভাব দেখে বিস্মিত হই। বলি,
কিরে ভয় লাগে না? আয় বাসায় চলে যাই।
সবাই হলে আছে, আমি কেন খামাখা যাব?
হেসেই উড়িয়ে দেয় সে। আমি তবু জোর করি। বলি, কিন্তু যদি কিছু হয়।
তুমি বড়ো ভীতু।
ভীতু মানুষকে ভীতু বলে গাল দেবার সুবিধা এই যে, তাতে সে রাগ করতে পারে না। মনের খবর প্রকাশ হয়ে যায় দেখে বিব্রত হয় শুধু। আমিও তাই বিব্রত মুখেই ফিরে আসি।
হলেও আমার কিছু করার নেই। অনার্স থিওরি পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি, প্রাকটিকেলের ফার্স্ট পেপারও হয়ে গিয়েছে। গণ্ডগোল শুরু হয় এর মধ্যেই। ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতুবি, প্রতিবাদে দেশব্যাপী হরতাল এবং একে অনুসরণ করে গ্রেফতার, গুলি, কারফিউ।
আমার রাজনৈতিক নিস্পৃহতার জন্যেই আমি এ-সমস্ত থেকে দূরে ছিলাম। শুচিবাইগ্রস্তদের মতোই আমি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করতাম। সংসারে যে-সমস্ত লোক বিজ্ঞাপন, অবিশ্বাস্য, মর্মন্তুদ, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন জাতীয় খবরগুলো খবরের কাগজের হেডলাইনের খবরের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়ে আমি সব সময় সেই দলের। যার ফলস্বরূপ আমি সবার ওপরই বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম। ইয়াহিয়ার ওপর বিরক্তি–কেন সে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পিছিয়ে দিলো। মুজিবরের ওপর বিরক্তি দুই একদিন পিছিয়েছে তাতে এত হইচই এর কি আছে। আসল কারণ পরীক্ষাগুলো দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে আমি উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম।
ছোটো ভাই ইকবাল (মেজো ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল) তখনো হলে সিট পায়নি। আমার সঙ্গেই থাকত। রাজনীতি বিষয়ে তার কতটুকু আগ্রহ ছিল জানি না কিন্তু মিটিং, মিছিল এই সমস্তে তার উৎসাহ ছিল। শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার জন্যে রাত তিনটায় বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে এর প্রমাণ মেলে। তার জন্যে উদ্বেগ ভোগ করতে হতো। সব সময় ভয় হতো এই বুঝি কোনো একটা ঝামেলায় পড়ল।
আবহাওয়া তখন খুব গরম যাচ্ছে। চারিদিকে মিটিং, মিছিল, বিক্ষোভ। শামুকের মতোই এ-সমস্ত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিজের খোলেই নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছিলাম। আমি যখন টমাস হার্ডির ‘এ পেয়ার অব ব্লু আইস’ পড়ে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলছি তখন শুনতাম ছেলেরা মিছিল করে যাচ্ছে। ভয় হতো এই বুঝি এসে বলবে ‘কি রে তুই গাধার মতো ঘুমুচ্ছিস আয় আমাদের সাথে।’ এর হাত থেকে বাঁচার জন্যেই রুমের সামনে লিখে রেখেছিলাম ‘Examinee, Don’t disturb, নীরবতাই কাম্য।’
দুপুরে ইকবাল এসে খবর দিল ফার্মগেটে গুলি হয়েছে। বিকেলের দিকে এল ইকবালের বন্ধু খাজা। নাটক না করে কিছুই বলতে পারে না। সে চোখ বড় বড় করে হাত নেড়ে মাথা দুলিয়ে যা বলল তা হলো হাইকোর্টের সামনে বাঙালি পুলিশ আর মিলিটারিতে সিরিয়াস ফাইট। দুই পক্ষেই গুলাগুলি, একশর উপর জখম। বলা বাহুল্য তার কথা বিশ্বাস হলো না। তবে কিছু একটা যে হয়েছে তার আঁচ পেলাম। সন্ধ্যা নাগাদ খবর পাওয়া গেল দুই পক্ষে মতান্তর হয়েছে ঠিকই। পুলিশরা রাইফেল ফেলে দিয়ে বলেছে ডিউটি করব না। দাবানলের মতোই খবর ছড়িয়ে পড়ল। মিলিটারি পুলিশ সংঘর্ষ। ছেলেরা উৎসাহে টগবগ করে ফুটতে লাগল। পুলিশ অফিসারের ছেলে হিসেবে আমি এতে যথেষ্ট গৌরববোধ করছিলাম। আমার হাবভাবে এমন প্রকাশ পাচ্ছিল যে আমি নিজেই এই গণ্ডগোলের সৃষ্টি করে মিলিটারির পিলে চমকে দিয়েছি।
অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। মিলিটারির ট্রাক, জিপ আর পশ্চিমা ই.পি.আর-দের নড়াচড়া চোখে পড়ার মতোই। হল থেকে যখনই দৈত্যের মতো ট্রাকগুলো দেখা যেত তখনই ‘দুর!’ ‘দুর!’ ধ্বনি উঠত সমস্ত হলগুলো থেকে। অতিরিক্ত উৎসাহীরা ছড়া কাটত
‘একটা দুইটা মিলিটারি ধর
সকাল বিকাল নাস্তা কর।’
পুলিশের গাড়িগুলোও অবশ্য এ-থেকে রেহাই পেত না। তবে তারা প্রায়ই ‘জয় বাংলা’ বলে চেঁচিয়ে বাজিমাত করত। ছেলেরা তখন ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’ বলে ষাড়ের মতোই চেঁচাতে থাকত।
শেফুর কাছ থেকে মজার মজার খবর পেতাম। কোনো এক মেয়ে বাড়ি থেকে চিঠি পাচ্ছে না কেলে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। কারা নাকি একটা মিলিটারি গাড়ির ওপর গরম পানি ঢেলে দিয়েছে উপর থেকে। আবার আরেকজন তিন তালা থেকে থুতু ফেলেছে এক পুলিশের গায়ে। অধিকাংশ গল্প গল্পই। অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর। বসে বসে শুনতে ভালোই লাগত। মেয়ে হলের ভিজিটার্স রুমটা যদিও সবদিক থেকেই ভিজিটারদের ডিসকারেজ করবার জন্যেই তৈরি তবু ছেলেরা সেখানে গেলে বড়ো একটা উঠতে চাইত না। মেয়েরা সেটা ভালো করেই জানত। শেফু যাতে আমাকে ঐ সব ছেলেদের দলে না ফেলে, যাতে না-ভাবে দাদাভাই (হুমায়ূন আহমেদকে তার ছোটো ভাইবোন দাদাভাই বলে ডাকত) দেখি বসে থাকতে থাকতে শিকড় গজিয়ে ফেলল সেই দিকে আমার কড়া নজর ছিল তাই তার সঙ্গে আমার কথা হতো অল্পই।