তার নিজের হাতে লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি সেভাবে রক্ষা করা হয়েছে কি না আমি নিশ্চিত নই—তাই আমার মনে হয়েছে অন্তত এক জায়গায় সেটি সংরক্ষিত থাকুক। একুশ বছরের একটি তরুণ কেমন করে লিখত সেই তথ্যটি অনেকের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক হতেই পারে। ভবিষ্যতে কেউ যদি গবেষণা করতে চায় এখান থেকে নিশ্চিত অনেক তথ্য পেয়ে যাবে।
এই পাণ্ডুলিপিটি মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা। মুক্তিযুদ্ধের সেই শ্বাসরুদ্ধকর সময়টি এখানে খুব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। এটি মূলত আমাদের পরিবারের কথা, কাজেই পড়ার সময় একাত্তরের সেই সময়ের ছবিটুকু আবার আমার চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। যারা একাত্তর দেখেনি, তারা এটি পড়ে সেই দুঃসহ সময়ের অনুভূতিটুকু খানিকটা হলেও অনুভব করতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক সময়টাতে সারা দেশে একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ ছিল। এই লেখাটিতে সেটি খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একটা মহকুমার দায়িত্বে থাকা আমার পুলিশ অফিসার বাবা অত্যন্ত জটিল একটা সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের টানাপোড়নের মাঝে কীভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছেন সেটিও এখানে খুব স্পষ্ট।
হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণ কথাশিল্পী হলেও সে খুবই দুর্বল ইতিহাসবিদ। আমি সবাইকে সতর্ক করে দিই, তার কোনো লেখা থেকে কেউ যেন কখনো কোনো ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা না করে। আমি লক্ষ করেছি কোনো একটা বিচিত্র কারণে সত্য ঘটনার খুঁটিনাটি নিয়ে সে কখনো বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাত না। তার নানা বইয়ের নানা স্মৃতিচারণে অনেক কিছুই আছে, যেখানে সে একটু কষ্ট করে নির্ভুল সঠিক তথ্য দিতে চেষ্টা করেনি। আমি সেটা ভালো করে জানি, কারণ আমাকে নিয়ে কিছু একটা লিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে সে এমন চমকপ্রদ কিছু কথা লেখে যা প্রায় সময়েই অনেক অতিরঞ্জিত। বৈজ্ঞানিক তথ্যও তাকে বলে দেওয়ার পরেও শুদ্ধ করার চেষ্টা করে নি। আমার একজন বয়স্ক আমেরিকান বন্ধু আমাকে বলেছিল, Dont ruin a good story with facts–হুমায়ূন আহমেদ হচ্ছে এই দর্শনের সবচেয়ে বড় অনুসারী! সে ছোটোখাটো সত্য দিয়ে কখনোই মজার একটা গল্প নষ্ট করেনি!
এই বইয়ের যে সব তথ্য সঠিক নয় বলে আমি নিশ্চিতভাবে জানি তার কয়েকটা উদাহরণ এইরকম :
ক) তার নিজের উপন্যাসের যে কাহিনিটি বর্ণনা করা হয়েছে সেটি নন্দিত নরকের কাহিনী নয়। সেই কাহিনীটি শঙ্খ নীল কারাগারের। সম্ভবত নন্দিত নরকে নামটি তার প্রিয় নাম, ভেবেছিল এই বইয়ে এই নামটিই দেবে, শেষ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি দিয়েছিল তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসের। (পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭)।
খ) পঁচিশে মার্চ রাতে পিরোজপুর থানায় আমার বাবা একা ওয়ারলেস রুমে যুদ্ধ শুরুর ঘটনা শুনেন নি আমরা সবাই তার সাথে ছিলাম। (পৃষ্ঠা ৭৪-৭৫)
গ) আমার বাবাকে ফিরে পাওয়ার চিঠিটি নাজিরপুরের ওসি লিখেনি— লিখেছিল পিরোজপুরের ওসি। (পৃষ্ঠা ১৪২/১৪৩)
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরো বের করা সম্ভব, কিন্তু আমার ধারণা–কী বলতে চাইছি সেটা এই উদাহরণগুলো দিয়েই বোঝা সম্ভব। কাজেই ইতিহাসবিদরা তাকে ক্ষমা করে দেবেন।
এই বইটির দ্বিতীয় ভাগে আমার অংশটুকু জুড়ে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র আমার বাবার জীবনের পরিসমাপ্তির ঘটনাটুকুর পুরোটা পূর্ণ করার জন্যে। যেভাবে লিখেছিলাম মোটামুটি সেভাবেই আছে, বোঝার সুবিধের জন্যে কোথাও হয়ত একটি-দুটি শব্দ যোগ করেছি কোথাও বাদ দিয়েছি। দীর্ঘদিন পর, সেই টিন-এজ বয়সের লেখা পড়ে আমি নতুন করে এক ধরনের কষ্ট অনুভব করেছি। একাত্তরে লক্ষ লক্ষ পরিবার এই কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। অসংখ্য পরিবার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে–আমরা খুব ভাগ্যবান যে, আমরা টিকে গেছি। আমার ধারণা আমরা যে-টিকে আছি এ-ব্যাপারে আমার মায়ের একটা খুব বড়ো ভূমিকা আছে।
হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণের পাণ্ডুলিপির মাঝে দুটি পৃষ্ঠা নেই। একটি সত্যি সত্যি হারিয়ে গেছে। অন্যটি দেখে মনে হয় সম্ভবত পৃষ্ঠাসংখ্যা দেওয়ার সময় ভুল করার কারণে পৃষ্ঠা সংখ্যার এই গরমিল।
হুমায়ূন আহমেদ এই পাণ্ডুলিপির কোনো নাম রেখে যায়নি। সে নিজে নাম দিলে খুব চমৎকার একটা নাম দিতে পারত। আমি পাণ্ডুলিপির বিষয়বস্তুর সাথে মিল রেখে এর নামকরণ করেছি ‘একাত্তর এবং আমার বাবা’। এখানে একাত্তর যেটুকু আছে আমার বাবাও প্রায় ততখানিই আছেন। আমার মনে হয়েছে এই লেখাটি ছিল আমাদের বাবার জন্যে হুমায়ূন আহমেদের এক ধরনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
হুমায়ূন আহমেদ যখন এটি লিখেছে তখন সে পুরোনো বানান রীতিতে লিখেছে, এখানে যেহেতু হুবহু তার হাতের লেখার অংশটুকু আছে তাই পাঠকদের কাছে উপস্থাপনের জন্যে ছাপা অংশটুকুতে প্রমিত বাংলা বানান রীতি প্রয়োগ করে এক ধরনের সমতা বিধানের চেষ্ঠা করা হয়েছে। এ-ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জফির সেতু। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই।
এই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদের পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে বের করার জন্য আমি ভাতৃবধূ রীতার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার অংশটুকু প্রায় কাকতালীয়ভাবে ছোটোবোন শিখুর কাছে ছিল। তাদের দুজনের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। বইটির প্রচ্ছদ তৈরী করে দিয়েছে অনুজ আহসান হাবীব। প্রচ্ছদে বাবার ছবিটি এসেছে বড়বোন সুফিয়া হায়দারের সংগ্রহ থেকে। হুমায়ূন আহমেদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছবিটি দিয়েছে ছোট বোন রোখসানা আহমেদ। এটি হুমায়ূন আহমেদের শেষ বই, এ বইটিতে কীভাবে কীভাবে জানি পরিবারের সবার ভালোবাসার স্পর্শ রয়েছে।