ডাক্তার সাহেবের বাসা থেকে আমার জন্যে নাস্তা পাঠান হলো, ডাক্তার সাহেব আমায় ডেকে নিয়ে তাদের ঘরে বসালেন। খালাম্মা। খুবই সহজ সরল মানুষ, আমায় ছেলেমানুষ ভেবে অবাস্তব সব কথা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। নিজের ছেলে মেয়েদের বলছিলেন, যাও, তোমার ইকবাল ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসে গে। যে-শিশুরা গত বিকেলে সারাক্ষণ আমার কোলের ওপর বসে কাটিয়েছে, এখন তারাই আমার কাছে ঘেঁষল না, পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি মারতে লাগল।
আমি সারাক্ষণই কাঁদছিলাম। প্রথম সান্ত্বনা পেলাম ডাক্তার সাহেবের কাছে। আমায় একসময় বললেন তুমি এখনই কাঁদছ কেন? আগে সত্যি জেনে নাও তোমার আব্বা মারা গেছেন কি না। আমি চোখ মুছলাম, সত্যিই তো আমি কেন ভাবছি আব্বাকে গুলি করা হয়েছে? কী প্রমাণ আছে? ডাক্তার সাহেব আফজল সাহেবকে বললেন খবর আনতে, আমি অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। যখন ফিরে। এলেন আমি জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তারা বললেন, তিনি জানতে পারেন নি। তবে কর্নেলকে বলে এসেছেন ট্রায়াল ছাড়া যেন বিচার করা না হয়।
আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তখনো বাকি। আম্মাদের কাছে এই খবর নিয়ে পৌঁছাতে হবে। কোনো পাকা খবর নেই আব্বাকে নিয়ে গেছে এতটুকু মাত্র জানি, তারপর কি হয়েছে কে জানে। দুপুরে ভাত খেলাম ডাক্তার সাহেবের বাসায়। নয় মাইল হেঁটে এই খবর নিয়ে যেতে হবে। শক্তির দরকার।
সব টাকা ছিল আব্বার কাছে। তাই ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে টাকা নিলাম। ট্রেজারি লুট হয়েছে কাজেই নতুন নোট কেউ নিতে চায় না। ডাক্তার সাহেব বেছে বেছে পুরানো নোট দিলেন। শার্টপ্যান্ট না পরে লুঙ্গি আর শার্ট পরলাম, রশিদ মাথায় পরিয়ে দিলো তার টুপি। তারপর রওনা দিলাম।
পিরোজপুর থেকে হুলারহাট পর্যন্ত সাড়ে তিন মাইল রিকশায় যাওয়া যায়, কিন্তু আমাকে এ-জায়গাটুকুও হেঁটে যেতে হলো। সব রিকশাওয়ালারা নাকি লুট করতে বের হয়েছে। রাস্তা চিনি না তাই সঙ্গে রয়েছে ইসমাইল।
নয় মাইল যেতে যেতে আমি কখনো কখনো হাঁটা ছাড়া আর সবকিছু ভুলে গেলাম, কিন্তু যখনই সব মনে পড়ত তখনই মনে হতো আমার বুক ফেটে যাবে। আমি কোন মুখে আম্মাদের এ-খবর জানাব, এ-খবরের পর তাদের কি অবস্থা হবে ভেবে আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। আমি জেনেছি আস্তে আস্তে, তারা সেটা জানবে হঠাৎ করে একবারে। কি সাংঘাতিক একটা আঘাত পাবে।
যতই বাবলা গ্রাম কাছে আসতে লাগল ততই আমার পা আটকে আসতে লাগল। পথে ছিন্নমূল অসহায় হিন্দু পরিবারগুলোকে দেখেও আমার অনুভূতির কোনো তারতম্য হলো না। বাবলা খালের সাঁকোটা পার হতেই খাঁ সাহেবের একজন ছেলে সঙ্গ নিলো। জিজ্ঞাসা করল, কী খবর? আমি বললাম, ভালো।
বাড়িতে পৌঁছে আমার মনে হলো যদি এ-খবর আগেই পৌঁছে যেত তাহলে আমার কিছু বলতে হতো না। কিন্তু এখনো কোনো খবর পৌঁছেনি। খবর দেওয়ার জন্যে আমি ঘরে ঢুকলাম।
প্রথমে শেফু পরে আম্মা নামলেন। শেফু জিজ্ঞেস করল, কী। খবর?
খারাপ খবর। তোরা কিছু শুনিস নি? শেফুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, না! কী?
আমি এক নিশ্বাসে সব বলে দিলাম। আব্বা মিটিংয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেন নি, কেউ কেউ বলছে গুলি করে দেওয়া হয়েছে। আম্মা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সিঁড়িতেই বসে পড়ে মুখে আঁচল গুঁজলেন, কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, আমি নিজের হাতে মেরে ফেলেছি। আমি নিজের হাতেমেরে ফেলেছি।
প্রথমবারের মতো আমাদের পূৰ্বিারের সবার কান্নার শব্দ হাহাকার করে উঠল।*
[* স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বলেশ্বরী নদীর তীর থেকে ফয়জুর রহমানের দেহাবশেষ। উদ্ধার করে জানাজা পড়িয়ে পিরোজপুরের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।]