সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। ডাক্তার সাহেবের বাসা থেকে এক গ্লাস দুধ পাঠালেন খালাম্মা। আমার গিয়ে দেখা করা উচিত কিনা ঠিক করতে পারলাম না। সন্ধ্যার দিকে কোর্ট ইন্সপেক্টর সাহেব রশিদকে দিয়ে তার বিছানা নিয়ে গেলেন।
বেশ আঁধার হয়ে এসেছে তখর। রশিদ এসে বলল, আফজল সাহেবের বাসায় যে মুনশি থাকে, সে বলেছে সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসারকে নাকি গুলি করে করে মেরে ফেলেছে।
ধ্বক করে আমার বুক কেঁপে উঠল। এই প্রথম আমার আব্বার জন্য চিন্তা হলো। আব্বা এখনো আসেন নি।
দৌড়ে গেলাম ডাক্তার সাহেবের বাসায়। ডাক্তার সাহেব হতচেতনের মতো বেঞ্চে শুয়ে আছেন। আমাকে দেখে উঠে বসলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, চাচা ওরা সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসারকে নাকি গুলি করে মেরেছে?
আমিও এ-রকম কথা শুনে এসেছি, এসেই শুয়ে পড়েছি।
আব্বা–তাহলে আব্বা–
তোমার আব্বা এখনো আসেননি?
তারপর রশিদকে পাঠালেন থানায় খবর আনতে। আমি খবরাখবর নিলাম। মিটিংয়ে কে কে ছিল, কে কী বলেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। রশিদ খবর আনল সবাই চলে এসেছে। আবার যাবে একটু পরে। আব্বা কর্নেলের সঙ্গে আলাপ করছেন এখনো আসেন নি। খালাম্মা তাদের বাসায় থাকতে বললেন, আমি বললাম, না-না, আব্বা আছেন তো, আমার ভয় করবে না–
—
কারফিউর সময় হয়ে আসছে আমি বাসায় চলে এলাম। যতই সময় পার হতে লাগল, ততই দুশ্চিন্তায় আমার হতে পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল। আমি প্রতি মুহূর্তে আশা করছিলাম এই বুঝি দরজায় ধাক্কা শুনব, আর খুলেই দেখব আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন। আস্তে আস্তে আটটা বাজল, এখনো আব্বার দেখা নেই। আমি মনকে প্রবোধ দিলাম, আব্বার কিছু হয় নি, আব্বা ভাল আছেন। কর্নেলের সঙ্গে আলাপ করছেন। হঠাৎ কর্কশ স্বরে এক ঝাঁক গুলির তীব্র আওয়াজ হলো, খুব কাছে। সাথে সাথে আঁ-আঁ-আঁ করে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল। আমি শিউরে উঠে পর মুহূর্তে বুঝতে পারলাম, মানুষের চীৎকার নয় কাক। আমার সারা শরীর শীতল হয়ে উঠল। আশে পাশে এখানে সেখানে গুলির আওয়াজ, প্রতিটা গুলির শব্দ আমার স্নায়ুকে ভয়ানক আঘাত দিয়ে দিয়ে একেবারে দুর্বল করে তুলল। আমি বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া, দোয়া ইউনুস পড়তে চাইলাম, মনে পড়তে চাইল না, মুখে আটকে যেতে লাগল।
মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলাম আব্বা কর্নেলের সঙ্গে আলাপ করছেন। আসবেন আরেকটুকু পরে। অশুভ চিন্তা মনে আসতে চাইলেই আমি সেটাকে জোর করে সরিয়ে দিচ্ছিলাম, এইভেবে যদি কয়েকজনকে গুলি করে মারতে চায় তাহলে এলোপাথাড়ি আওয়াজ হবে না, আওয়াজ করতে হবে সুনির্দিষ্ট। একটু পরে পরে। দশটার দিকে আটটা গুলির আওয়াজ শুনলাম, সুনির্দিষ্ট শব্দ, একটার পর একটা আমার মনে হলো আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাব।
আমার চিন্তা করার ক্ষমতা নেই, ভাববার সময় নেই, শুধু প্রার্থনা করছি–আল্লাহ বাঁচাও–তুমি প্রাণ ভিক্ষা দাও…
রশিদ আর ইসমাইল বারবার আমাকে ভাত খেয়ে নিতে বলল ভাবখানা আমাকে এখন ভাত খাওয়াতে পারলেই একটা মস্তকিছু কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে!
আমি থানায় ফোন করি নি, ভয় লাগছিল–যদি শুনতে পাই আর সবাই ফিরে এসেছে শুধু আব্বা আসেন নি। এমন সময় টেলিফোন বাজল, নাজিরপুরের ও. সি. আব্বাকে খুঁজছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের পরিবারকে নাজিরপুরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে নৌকা পাঠাতে হবে কি না–
আমি বললাম, না না এখন না। কি ভেবে বললাম, জানি না।
এগারোটার সময় আমি ফোন করলাম থানায়। জিজ্ঞেস করলাম, আব্বা সামনে আছেন?
না তো, এখনো আসেন নি!
না? ও.সি. সাহেব, সি.আই সাহেব…
তারা তো সবাই ও.সি. সাহেবের বাসায় ঘুমিয়ে আছে।
আমার সবকিছু জিজ্ঞেস করা ফুরিয়েছে।
বাকি রাতটা কেটেছে অবর্ণনীয় দুশ্চিন্তায়। লিখে সেটা প্রকাশ করা যায় না। দরকারও নেই— এদেশে একজন মানুষের দুঃখ কষ্ট দুশ্চিন্তার কোনো মূল্য নেই, এটা নতুন নয়, অভাবনীয়ও নয়।
সকালে রশিদ খবর আনতে গেল। খবর নিয়ে এল কাঁদতে কাঁদতে। চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছে, আমার বুঝতে বাকি রইল না সে কি খবর এনেছে। বললো, ভাই আপনে বাড়ি যান। ছোটো জমাদার বলেছে গত রাতে সাহেবকে গুলি করেছে।
এরপরে বহুবার বহুভাবে এ-খবর শুনেছি কিন্তু প্রথম বার শুনে আমার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল একটু অদ্ভুত, আমি শুধু যন্ত্রের মতো মনে মনে নিজেকে বলছিলাম, পৃথিবীর সব দুঃখ সময়ের সাথে কমতে থাকে। দুঃখ সময়ের সাথে কমতে থাকে। আমার অবাক লাগছিল। এইভেবে সময়ও কি আমায় এই দুঃখের ওপর প্রলেপ বুলাতে পারবে?
আমি প্রথমে গেলাম ও.সি. সাহেবের বাসায়। ঢুকলাম অবাঞ্ছিতের মতো। সি.আই, কোর্ট ইন্সপেক্টর কিংবা ও.সি, সাহেব আমার দিকে তাকালেন নিরুৎসুকের মতো। আমার বক্তব্যেও তাদের যেন কোনো কৌতূহল নেই। আমি চেষ্টা করলাম, কান্না আটকিয়ে রাখতে, তবু গলার আওয়াজ হলো ভাঙা ভাঙা, চাচা, আব্বাকে নাকি গুলি করেছে, তাহলে ডেড বডি…
এ-খবরেও তারা চমকালো না। কোথা থেকে শুনেছ এ-ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল, আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর পেলাম না। এ ব্যাপারটা অসম্ভব এ-রকম আশ্বাসও দিলো না। একরকম উপেক্ষিত হয়ে বের হয়ে এলাম। রাস্তায় নেমে কান্না চাপতে পারলাম না।
কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসে ঢুকলাম।
খালি বাসায় বারান্দায় বলে আমি কাঁদতে লাগলাম, হরিণটা বার বার এসে আমাকে শুঁকে শুঁকে গেল। রশিদ ইসমাইল আমায় সান্ত্বনা দিচ্ছিল—মানুষের কষ্টের সময় সান্ত্বনাবাক্য যে কি খারাপ লাগে আমি আগে জানতাম না।