এস.ডি.পি.ও কাহা?
রশিদ জানাল, সে বলল, গ্রামে ট্যুরে গিয়েছেন।
মিলিটারি বলেছে, ও ভাগ গিয়া!
রশিদের মতে মিলিটারিরা টাউনে কোনো অত্যাচার করে নি–মেজর সাহেব নাকি খুব ভাল মানুষ! শুধু কয়েকজন হিন্দুর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। বাসায় পৌঁছে দেখি প্রকাণ্ড একটা পাকিস্তানি পতাকা শোভা পাচ্ছে। শুধু বাসায় না যেদিকে তাকানো যায় শুধু পাকিস্তানের পতাকা, বাসায়, দোকানে, রিকশায় এমনকি মানুষের পকেটে!
বাসায় ড্রয়িংরুম ফাঁকা, আসবাবপত্র শোয়ারঘরে গাদা করা। দুটো পালঙ্ক জড়ো করে জোড়াবিছানা, সবমিলিয়ে এক শ্রীহীন অবস্থা। আব্বা ও.সি.কে ফোন করে জানতে চাইলেন এখন কি করা। ওসি অভয় দিয়ে অফিসে চলে আসতে বললেন। আব্বা পোশাক পরলেন রশিদ সাহায্য করল। আব্বার ডান হাতের বোম খানিকটা কি ভাবে ছিঁড়ে গিয়েছিল, কিভাবে সেটা কাউকে বলেন নি, রশিদ সেটা ম্যানেজ করে দিলো। আব্বা একটা ডাইরি নিয়ে অফিসে গেলেন।
বাসায় চারিদিক থেকে ধূয়া উড়ছে–দুমদাম শব্দে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ভাঙা হচ্ছে–সে এক বিশ্রী ব্যাপার। আমি খানিকক্ষণ হরিণটাকে আদর করলাম। গোসল করে Wodehouse-এর একটা বই বের করলাম। রশিদ চা তৈরি করে দিলো, তার সুট করে আনা সম্পত্তি দেখাল। তখনই আমি প্রথম জানতে পারলাম মিলিটারিরা লুট করাচ্ছে। এখন আর লুট করা অপরাধ নয়, আইনগতভাবেও নয় নৈতিকভাবেও নয়। আমার মনটাই তেতো হয়ে গেল।
ভাত রাঁধা হলো, তরকারী কুখাদ্য–কৃমির মতো লম্বা লম্বা আতপ চাউল। আমি একলাই খেয়ে ফেললাম, আব্বা কখন আসেন ঠিক নেই। কিন্তু আব্বা আসলেন একটু পরেই। ইজিচেয়ারে বসলেন, মুখটা ভারি চিন্তাক্লিষ্ট। কথা না বলে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। ডাক্তার সাহেব আসলেন, তার মুখও কেমন বিবর্ণ উদ্ভ্রান্ত-উদ্ভ্রান্ত। ডাক্তার সাহেব আরেক কথা বললেন, মিলিটারি এসেই দু-জনকে মেরেছে, দুজনকে গুলি করেছে দৌড় দেওয়ার অপরাধে ইত্যাদি ইত্যাদি। আব্বা কোনো আলাপে বেশি উৎসাহ দেখালেন না, বার বার জিজ্ঞেস করলেন সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসার কই, কী ব্যাপার?
ডাক্তার সাহেব জানালেন তারা দুজন এসেছে খুব সকালে, সারা গায়ে কাদামাখা পাগলের মতো চেহারা। প্রথমে দেখা করেছেন আফজাল সাহেবের বাড়িতে, তিনি পাঠিয়েছেন হাসপাতালে। হাসপাতালে ডাক্তার সাহেব তাদের পোশাক বদলে দিলেন বাসায় এনে খেতে দিলেন দুধ, তারা খেতে চাইল না। তারপর দিলেন চা। চা খেলেন, কিন্তু দু-জনের কেউই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। একটু পরে কয়েকজন মিলিটারি আসল তাদের খোঁজে। ডাক্তার সাহেব জানালেন, তারা অসুস্থ। মিলিটারিরা বলল, রিকশায় বসতে পারবে তো, তাহলেই হবে। তারপর রিকশায় বসিয়ে তাদের নিয়ে গেল।
রশিদকে আব্বা একই কথা জিজ্ঞেস করলেন, রশিদ, সেকেন্ড অফিসার আর ফোর্থ অফিসার কই?
কেন স্যার? তারা তো তাদের বাসাতেই আছে। সেকেন্ড অফিসারের বাসাতেই মিলিটারিরা আশ্রয় নিয়েছে, কাজেই সেখানে গিয়ে সন্দেহ মিটানো সম্ভব ছিল না। আব্বা বারবার জানতে চাইছিলেন, তারা কি অ্যারেস্ট হয়েছে নাকি বাসাতেই আছে। কিন্তু কেউই এর সঠিক উত্তর বলতে পারল না, মিলিটারির এখন পর্যন্ত খারাপ রিপোর্ট নেই। আমরা ধরে নিলাম তারা বাসাতে ভালোই আছে। সেকেন্ড অফিসার আর ফোর্থ অফিসার সম্পর্কে আব্বার কৌতূহল। ওদের সম্পর্কে আমার জিজের কৌতূহল ছিল না, তাই ও ব্যাপারে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিই নি।
আব্বা গোসল করলেন, নামাজ পড়লেন, সেই অখাদ্য খাবার খেলেন। তারপর বিছানায় শুয়ে বললেন, বাবা আমায় চারটার সময় ডেকে দিবি। মিটিংয়ে যেতে হবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
বারটার সময় আব্বাকে ডাকতে গিয়ে দেখি আব্বা মোটেই ঘুমাননি–বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছেন মাত্র। সারা দুপুর আব্বার মুখ চিন্তায় যে-রকম ভারাক্রান্ত হয়েছিল
এখন তা আর নেই, বরং সমস্যা মিটে গেলে যে-রকম প্রফুল্লতা ফিরে আসে সেরকম প্রফুল্ল। আব্বা নিজেই উঠলেন–নামাজ পড়লেন, তারপর পোশাক পরে নিলেন, আমি বোতাম লাগিয়ে ভাঁজ ঠিক করে আব্বাকে সাহায্য করলাম। আব্বা যাবার সময় বাইরের ঘরের দরজার কাছে এসে আমাকে বললেন, বাবা, আমার জন্যে দোয়া করিস।
ডাক্তার সাহেবও মিটিংয়ে যাবেন, আব্বা যাবার সময় তাকেও ডেকে নিলেন।
আমার কোনো কাজ নেই। রশিদ কার ঘর লুট করে পুরো এক ড্রাম চাল এনেছে। আমাকে মাথায় দেবার সুগন্ধি তেল সেধেছে, তালা, তাস, পুরানো র্যাদ, লুট করতে কিছু বাকি রাখে নি। বারান্দায় বসে দেখলাম, হাসপাতাল থেকে গুলি খেয়ে মৃত এক রোগির লাশ রিকশায় সরানো হলো।
আমি বিকেলে বাসার সামনে এসে বসলাম। ডাক্তার সাহেবের বাসা থেকে, বাবু আফরিন ওরা এতদিন পরে আমাকে দেখে ছুটে এল, আমার সঙ্গে তাদের হাজারো রকম ছেলেমানুষি গল্প।
একটু পরে দেখলাম কুলির মাথায় করে এক লাখ টাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ট্রেজারি লুটের টাকা! কোত্থেকে জানি জোগাড় করা হয়েছে। আরও কিছুক্ষণ পর দেখলাম রিকশা করে মিলিটারি আসছে। তারা নকশালদের ধরে আনছে। ফজলুর হাত পিছমোড়া করে বাঁধা আড়ষ্টভাবে বসে আছে–খালি গা। মুখের ভাব উদ্ধত। আরও কয়জন ছেলে, একজনের চোখ বাঁধা। সবাইকে চিনি না। খবর নিয়ে জানলাম কোননা বাড়িতে লুকিয়ে ছিল গ্রামবাসীরা ধরে দিয়েছে।