আব্বা সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটালেন। শিখু তার বুকে হাত বুলিয়ে দিলো। নামাজের সময়গুলাতে যন্ত্র চালিতের মতো উঠে শুধু নামাজ পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কিরে নমাজ? নমাজ পড়লি না। সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ বাদশা এল। হাতে মস্ত এক রামদা। আমাদের আর হায়দারের খোঁজে এসেছে। সে যা বলল তা শুনে আমরা স্তম্ভিত। সে বলল এস.ডি.ও আর ট্রেজারি অফিসারকে আওয়ামী লীগের মুক্তিবাহিনী গ্রেফতার করে আটকে রেখেছে তাদের গেরিলা ট্রেনিংক্যাম্পে। সেখানে তাদের কিছুই খেতে দেওয়া হয় না, কারো সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হয় না। বাদশা খবর পেয়ে তাদের উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে। আব্বা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, যাক তারা দুইজন বেঁচে আছে আর ভয় নাই। রাত ৯টার দিকে এল আলী হায়দার। আব্বা খুব খুশি হলেন। বললেন, হায়দার সাহেব ট্রেজারি লুটের পিছনে অনেক রুই-কাতলা আছে, যদি বেঁচে থাকি তবে একদিন নিশ্চয়ই বলব।
রহুল মামাকে নিয়ে পরদিন চলে গেলাম শ্রীরাম কাটির বাজারে। দু-একটা জিনিস কিনতে। সেখানেই শুনলাম পিরোজপুরে মিলিটারি এসেছে। হুলারহাটে ৬ জনকে গুলি করে মেরেছে নেমেই।
খবর শুনে আব্বার কেনো ভাবান্তর হলো না। আর চুপচাপ হয়ে গেলেন। মোবারক খান (বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ মারা যাবার পর মোবারক খান বাড়ি থেকে পুরো পরিবারকে বের করে দিয়েছিল) প্রচুর যত্ন করেছে আব্বাকে। এটা খাওয়াচ্ছে, সেটা খাওয়াচ্ছে। মুখে এক বুলি এত বড় অফিসার আমার ঘরে কি দিয়ে যত্ন করি।
পরদিন ভোর ৯টায় একটা ছেলে এসে হাজির নাজিরপুরের o.c–র একটা চিঠি হাতে। চিঠি আমিই প্রথম পড়লাম, চমৎকার চিঠি। অনেকটা এই ধরনের :
‘… স্যার, আমাদের তো আল্লা ছাড়া কোনো ভরসা নাই আপনি আল্লার নাম নিয়েই পিরোজপুরে যান। এ-ছাড়া এই বিদেশ বিভূইয়ে আমরা কী করতে পারি? পিরোজপুরের o.c আমায় টেলিফোনে জানিয়েছেন কোনো ভয় নাই। তা ছাড়া খুলনারেঞ্জের DIG সব পুলিশ অফিসারদের বেলা বারোটার আগে হাজির হতে বলেছেন।’
বারোটার আগে জয়েন করতে হলে সময় নেই। আম্মা আব্বাকে ডেকে তুললেন। আব্বা চিঠি পড়েন আর জিজ্ঞেস করেন, কিরে যাব পিরোজপুরে? সবাইকেই প্রশ্ন। আমরা সবাই বলি, কোনো ভয় নাই যান। মিলিটারি এডমিনিস্ট্রেশন চালু করতে চাইছে কাউকে কিছু বলবে না। আব্বা নিজেও বলেন ঠিকিইতো, কই পালাব? আজ পালালে ছেলেপেলেসহ কালই ধরিয়ে দেবে। আব্বা আশা আর। আশঙ্কায় দুলতে দুলতে সেভ করলেন। চিড়া খেলেন। কাপড় পরলেন। নৌকা ঠিক হলো। আব্বার মুখ দেখে মনে হলো সাহস পাচ্ছেন। আব্বাকে সাহস দেবার জন্যে ইকবাল চলল সঙ্গে।
আমি আর আব্বা
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
যখন আমি আর আব্বা নৌকা করে রওনা দিই তখন আর সবাই নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে চুপচাপ রওনা দেওয়াটা আমার খারাপ লাগল। আমি ভাবলাম যাওয়ার সময় একটা কিছু আলাপ করে আবহাওয়াটা সহজ করি। শেফুকে জিজ্ঞাসা করলাম–আজ কয় তারিখ, পাঁচ না?
হ্যাঁ–পাঁচ।
লাকি ডেট, তাই না?
আমি জানতাম পাঁচ তারিখ নিউমোরলজি অনুযায়ী আমাদের জন্যে লাকি ডেট তবু সবার সামনে কথাটা বলে আতঙ্ক দুর্ভাবনা কমাতে চাইলাম। নৌকায় রওনা দিলাম। নৌকাটা ছিল ভাঙা–পানি উঠছিল সাংঘাতিক, একটু পরে পরে আমি পানি সেঁচছিলাম। বহুক্ষণ নৌকায় যেতে যেতে আব্বা একটাও কথা বলেন নি। একবার জিজ্ঞেস করলেন, সেকেন্ড আর ফোর্থ অফিসার কোনো গ্রামে আছে আমি জানি কি না? আমি গ্রামের নাম বললাম। আব্বা হিন্দু মাঝিটাকে জিজ্ঞেস করলেন, পথে পড়বে নাকি? মাঝি জানাল যে পড়বে না। আমার সঙ্গে আব্বার আর কোনো কথা হয়নি–পথে শুধু এক চেয়ারম্যান আব্বার সঙ্গে খানিক আলাপ করেছিল। চেয়ারম্যান তখন খুব ব্যস্ত, চারদিক ভয়ানক লুটপাট। আব্বা তাকে বললেন আপনারা এটা বন্ধ করেন বাকিটুকু আমরা ঠিক করব। তখন চেয়ারম্যান আরও খানিকক্ষণ আলাপ করল, নৌকা থামেনি, কাজেই আলাপ বেশিক্ষণ চলতে পারে নি। পথে আরেকজন লোকের সঙ্গে দেখা। শক্তসমর্থ শরীর, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। আব্বাকে দেখে ভারি অবাক হলো, স্যার? আপনি যাচ্ছেন?
আব্বা হাসলেন, বললেন, দেখে আসি। লোকটার বিশ্বাস হয় না, জিজ্ঞেস করল, সত্যি যাচ্ছেন? সাহস পান?
আলাপ চালানোর জন্যে সে নৌকার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল, মিলিটারি সম্পর্কে তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানাল। আমরা যাচ্ছি মিলিটারির কাছে, তাই তার সব কথা বিশ্বাস করলাম না।
আমাদের নৌকা যখন কালীগঙ্গা নদীতে পড়ল তখন চারিদিকে আঁতিপাতি করে খুঁজেও আমি আর একটাও নৌকা দেখলাম না। হুলারহাট ডকটা একেবারে নির্জন। আমার কেমন খারাপ লাগল–একটু ভয় ভয়ও। নদী দিয়ে একটা সাদা লঞ্চ আসছিল–ওপরে পাকিস্তানি পতাকা। দেড়মাস পরে আবার আমি ভাবলাম গানবোটই নাকি কে জানে। নৌকা হুলারহাটে পৌঁছালে আমরা উপরে উঠে দেখি রশিদ মাথায় একটা টুপি চাপিয়ে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ যে ভয় ভয় লাগছিল রশিদকে দেখে সেটা একটু দূর হলো। রিকশা চেপে রওনা দিলাম। রশিদ মাঝে সাইকেল চালাতে চালাতে মিলিটারির গল্প করছিল। তার মুখ থেকে শুনলাম সেকেন্ড অফিসার আর ফোর্থ অফিসার সকালেই এসে গেছেন। পিরোজপুরে পৌঁছে মিলিটারির পজিশন নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসেছে, ফাঁকা আওয়াজ করেছে, কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হয়েছে অর্থাৎ রীতিমত যুদ্ধাভিযান। আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছে।