ইকবাল সন্ধ্যাবেলা আব্বাকে টেলিফোন করতে গেল। ফিরে এসে বলল আব্বা ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। বলেছেন আমরা যেন সকাল-বিকাল তার সঙ্গে আলাপ করি, শফু-শিখুও যেন করে।
পরদিন সকালে আমি টেলিফোন ধরলাম।
‘কি রে বাচ্চু এত ককেলি সকাল-বিকাল টেলিফোন করতে আর তোরা চুপচাপ।’
‘করব আব্বা, সকাল-বিকালই করব।’
‘মন বড় খারাপ থাকে, একটা দিন যায় আর মনে হয় আরেকটা দিন বাঁচলাম। তোরা কথা বললে তাও একটু ভাল লাগে।’
নকশাল-আওয়ামী গণ্ডগোল মিটেছে আব্বা?’
‘হ্যাঁ উপরে উপরে মিটমাটই। মনি ভালো আছে?’
‘জি।’
‘ভয়-টয় লাগে?’
‘না। টেলিফোন রাইখা দিব?’
‘কি এত তাড়াতাড়ি। বিদেশি খবর টবর বল…’
বরিশাল শহর মিলিটারি দখল করে নিলো অল্প আয়াশে। তিন দিক থেকে সাড়াশি আক্রমণ চালিয়ে, উপর থেকে বোমা বর্ষণ করে মুক্তিবাহিনীকে হটিয়ে দিলো। চারিদিকে সবাই এতে ভয় পেয়ে গেল। আলী হায়দার একদিন এসে আমাদের সরিয়ে নিলো বাবলায়। এক ব্যারিস্টারের আত্মীয় এই পরিচয়ে সে ব্যারিস্টারের বাড়ি নিয়ে তুললেন আমাদের। প্রকাণ্ড দোতালা বাড়ি, বাড়ির মালিক মোবারক খান প্রবীণ বয়স্ক লোক, তিনি পরম সমাদরে আমাদের গ্রহণ করলেন। চারিদিক থেকে লোক ভেঙে পড়ল আমাদের দেখতে। ‘আহা এই দুঃসময়ে কি কষ্টেই না এরা পড়েছে।’ সবার মুখে এই কথা। ‘কি যত্নের মানুষ এরা কি দিয়ে এদের সমাদর করি।’
কিন্তু কেন জানি না এত যত্ন এত সমাদর সত্ত্বেও আমি খুব দমে গিয়েছিলাম। হয়ত জায়গাটির পরিবেশই মনের ওপর কাজ করছিল। জায়গাটা কেমন যেন দম বন্ধ করা। চারিদিকে ঘন বন জঙ্গলে আচ্ছন্ন, একটুকুও খোলামেলা নয়। কেমন একটা দমবন্ধ করা ভাব। দু-দিনেই আমি হাঁপিয়ে উঠলাম। আলী হায়দার সেই আমাদের রেখেই পালিয়েছে আর খোঁজ নেই। বলে গেছে under ground-এ থাকতে হচ্ছে, তবে কাছাকাছিই আছি। আমরা একেবারে একা পড়ে গেলাম। থাকার বন্দোবস্ত হলো দুই ভাগে। মেয়েরা দু-তলায়। ছেলেরা নিচের তলায়। বাড়িতে কঠিন পর্দা, কাজেই আমরা আম্মা আর শেফু শিখুর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। তৃতীয় দিনে আলী হায়দার আবার এল। হাসি তামাশায় বেশ কাটল দিনটা। রাতে খেতে বসেছি কে এসে যেন বলল, খুব খারাপ স্তর, পিরোজপুরে ট্রেজারি লুট করেছে নকশালরা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে খুব গোলাগুলি হয়েছে। বেশ কয়েকজন মরেছে। বুকের ভিতর ধ্বক করে উঠল। ভাত বিস্বাদ হয়ে গেল। আলী হায়দার যদিও বারবার বলছে ও কিছু নয়, সব জায়গায় ট্রেজারি লুট হয়েছে; তবুও তার মুখ আতঙ্কে কালো হয়ে উঠল। আলী হায়দারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম আব্বা বাবলায়, আমাদের বর্তমান ঠিকানা জানেন না। এই বিপদে কোথায় যাবেন তিনি? দারুণ দুঃশ্চিন্তায় রাত কাটল। পরদিন খুব সকালেই ইকবাল আর ইউনুসকে পাঠালাম নাজিরপুর। সেখান থেকে টেলিফোনে আব্বার সঙ্গে আলাপ করবে। আমি আর রহুল মামা চললাম পিরোজপুর। প্রায় আট মাইল রাস্তা। মানসিক উৎকণ্ঠায় খুব দ্রুত গতিতেই হাঁটছিলাম দু-জন। কোনোরকমে পিরোজপুরে পৌঁছতে পারলে বাঁচি। রাস্তায় অনেক পরিবারের সঙ্গে দেখা হলো তারা সবই শহর ছেড়ে গ্রামে এসে পড়ছে। অনেকেই আমাদের শহরে যেতে মানা করল। এরা সবাই নকশালদের ওপর বিষম ক্ষ্যাপা বলছে, এরা নকশাল নয় টাকশাল। শহরের উপকণ্ঠে আসতেই দেখা হলো জনাকয় বন্দুকধারী লোকের সঙ্গে। তারা আমাদের দেখে থমকে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে একজন বলল–
‘আপনি SDPO সাহেবের ছেলে?’
‘জি।’
‘চেহারায় অদ্ভুত মিল। মুখ দেখেই চিনেছি। কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আব্বার খোঁজে পিরোজপুর।’
‘আরে তাঁর সঙ্গে কাল রাতে দেখা হয়েছে আমার। তিনি তো আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। পাগলের মতো। ঠিকানা জানেন না তো।’
‘আপনি বরংচ নাজিরপুর যান। শহরে গিয়ে মরবেন নাকি?’
ফিরে চললাম, মনে দারুণ উদ্বেগ। কি মুশকিল আলী হায়দার ঠিকানাটা পর্যন্ত জানায়নি। এখন কি উপায়। ঘামতে ঘামতে পরিশ্রমে আধমরা হয়ে পৌঁছলাম। শুনলাম ইকবাল এসেছে, খবর এনেছে আব্বা রওনা হয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো এসে পড়বেন।
আব্বা আসলেন সন্ধ্যা নাগাদ। সে ছবিটা খুব স্পষ্ট মনে আছে। খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, পাগলের মতো চাউনি, মুখ শুকিয়ে কালো হয়ে উঠেছে। ক্লান্ত আর অবসন্ন পায়ে তিনি উঠে আসলেন। সঙ্গে নাজিম ভাই আর দু-জন বন্দুকধারী জোয়ান। আব্বা বিছানায় বসে হাঁপাতে লাগলেন। গল গল করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে তার কপাল বেয়ে। ঘন ঘন জিব বের করে ঠোঁট ভিজাচ্ছেন। কাছে বসে মোবারক খান অসংখসংলগ্ন প্রশ্ন করে আব্বাকে বিরক্ত করতে লাগল। তিনি ক্লান্তগলায় প্রতিটির জবাব দিতে লাগলেন। আম্মা একটা পাখা নিয়ে তাকে হাওয়া করতে লাগলেন। আমি তাকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যেই মামাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে চলে গেলাম। মনটা অনেক হালকা।
[এখানে পৃষ্ঠা নম্বরের ধারাবাহিক পাতা নেই, তবে মনে হয় পৃষ্ঠা হারিয়ে যায়নি; পৃষ্ঠা নম্বর দিতে ভুল হয়েছে।]
ট্রেজারি লুট সম্বন্ধে আব্বা বিশেষ কিছু বললেন না। তিনি কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। যা বললেন তার থেকে এইটুকু বুঝা যাচ্ছিল যে, দু-জন নকশাল রোববার সকালে হঠাৎ দুটি স্টেনগান হাতে এস,ডি,ও আর ট্রেজারি অফিসারের ঘরে ঢুকে পড়ে। তারপর বলে ট্রেজারি খুলে দাও, নয়তো মর গুলি খেয়ে। সকাল ৯টায় দিনে দুপুরে ৯ ট্রাঙ্ক টাকা নিয়ে যায় তারা, আব্বাকে একদল নকশাল ঘিরে রাখে। আওয়ামী লীগ টাকাটা নিজেদের কাছে রাখতে গিয়ে বাধা দেয়, তাতে প্রচুর গুলি বর্ষণ হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি তাজুল ইসলাম মেশিনগান দিয়ে খটাখট গুলিবর্ষণ করে চলে নকশালদের ওপর। তিনজন নকশাল মারা পড়ে এতে।