ভদ্রলোকের নাম আই. সি. বিশ্বাস। T.B. clinic-এর ডাক্তার। মিলিটারির ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। স্ত্রীকে সিঁদুর পরতে দিতেন না, হাতে শাঁখা-নোয়াও নেই যাতে সন্দেহ না হয় যে, সে হিন্দু। বেশিদিন পালিয়ে থাকতে না পেরে শেষমেষ মুসলমান হয়ে গেলেন। এখন তিনি মোহাম্মদ ইয়াকুব খান।
একটি কুকুরকে দেখলাম একটি মৃতদেহ টেনে নদীর পানি থেকে শুকনায় উঠিয়ে পরম তৃপ্তিতে লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে খাচ্ছে। সাবাস পাকিস্তান।
পিরোজপুরে দ্বিতীয় খুনটি করল উত্তেজিত মানুষ। যাকে মারল তার একটিমাত্রই দোষ, সে অবাঙালি। অবাঙালিরা যে-নির্যাতন চালাচ্ছে তার খবর আসত হরদম। বাঙালির sentiment আগুন হয়ে জ্বলছিল। হতভাগ্য বিহারিটা সেই আগুনকেই প্রজ্বলিত করল শুধু।
পিরোজপুরে কিছু অবাঙালি পরিবার ছিল। তাদের নিরাপত্তার জন্যে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলো। এর উদ্যোক্তা হলেন আলী হায়দার খান আর আব্বা নিজে। পুলিশের মধ্যে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি কনস্টেবল ছিল, তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। 0.c সাহেবের বাসায় তার নিরাপত্তার জন্যে আব্বা বিশেষভাবেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। সিন্ধের SDO সাহেব তার অনেক আগেই আশঙ্কা আঁচ করে বরিশালের ADC-র বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। গভীর রাতে টেলিফোন এলো একবার। করেছেন বরিশালের SDPO মহিবুল্লাহ শাহ–
‘ভাল আছেন SDPO সাহেব?
‘জি, আপনি ভালো?’
‘আছি আর কি। আপনাকে একটা কথা বলবার জন্যে phone করেছিলাম।
‘বলুন।’
‘বাংলা স্বাধীন হবে’ বলতে বলতে হাউ মাউ করে শিশুর মতই কেঁদে উঠলেন তিনি।
পিরোজপুরের বাসা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে এলাম নাজিরপুর। আব্বা সেখানেই রইলেন।
নাজিরপুরের বাসাটা ছিল একটা বাংলো বাড়ি। হসপিটেলের মেডিকেল অফিসারের কোয়ার্টার। চমৎকার পরিবেশ সামনে নদী, চারিদিকেই ভীষণ খোলামেলা। বড়ো সড়ক ধরে হাঁটতে কি যে চমৎকার লাগত। চারিদিকে সবুজে সবুজে একেবারে সয়লাব। দিন কাটত গল্পের বই পড়ে আর তাস খেলে। নিজেদের সুবিধার জন্যে তাদের তাস খেলা শিখিয়ে নিয়েছিলাম। পাড়ার হিন্দু বৌ-ঝিরা বেড়াতে আসত। আম্মার সঙ্গে ভারি খাতির হলো, তাদের বাসায় আম্মাকে ধরে নিয়ে যেত। যুদ্ধের কথা শুধু মনে পড়ত খবর শোনার বেলা। মামির তখন Pregnancy first period. যা-ই মুখে দেন বমি করে ফেলে দেন। শুধু তাই নয় কেন জানি না কারো সঙ্গে কথা বলেন না, চোখ তুলে তাকান না। কি অসুবিধা তাও বলেন না। সে ভারি বিশ্রী পরিস্থিতি। আম্মা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দেশের এমন নাজুক পরিস্থিতিতে মামির ভূমিকাটা আমাদের সবার খুব খারাপ লাগছিল।
এদিকে আব্বা আছেন একা একা। রান্না বান্নার জন্য আছে রশীদ। রাতে আমাদের বাসাতেই থাকেন কোর্ট ইন্সপেক্টর। নাজেম ভাইও থাকেন। আম্মারই ব্যবস্থা। সেইখানেই খাওয়ার ব্যবস্থা।
এদিকে নাজিরপুরের o/c আমাদের বেশ যত্ন করছিল। সকাল বিকাল খোঁজ নিত। রাতে দু-জন পুলিশ এসে পাহারা দিত। দুধ পাঠাত নিজের বাড়ি থেকে। লোকটাকে একটুও ভালো লাগত না।
ধূর্ত চেহারা, নোংরা জামা কাপড়, ভিজে বেড়াল ভিজে-বেড়াল ভাব। সব মিলিয়ে ভীষণ বাজে। তার মতে, সমস্ত দুর্গতির মূলে মুজিবুর এবং মুজিবুর একটা জন্মচোরা।
নাজিরপুর বাসায় একজন ডাক্তার আসত। গ্রাম্য কোয়াক। হোমিওপ্যাথি, এলোপ্যাথি, কবিরাজি হাকিমি সমস্ত মিলিয়ে তার ডাক্তারিবিদ্যা। নাড়ু গোপাল নাড়ু গোপাল চেহারা। একবার আসলে আর নড়তে চাইত না। মামির নাড়ি ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত। রোগিনীর জন্যে ঔষধত বটেই পথ্য পর্যন্ত পাঠাত। নিজে সে জামাতে ইসলামের একনিষ্ঠ পাণ্ডা। তার ধারণা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া মানেই সমস্ত মুসলমানের হিন্দু হয়ে যাওয়া। তার যুক্তি ছিল হাস্যকর আর উদ্ভট ‘বাঙালির স্বভাব খারাপ কাজেই বাঙালিরা গোলামই করবে। বেশি ‘জয় বাংলা’ বলেছ যে তাই আল্লাহ্ টাইট করতে মিলিটারি পাঠিয়েছেন’ এই জাতীয়।
যাই হোক দিন মন্দ কাটছিল না। টেলিফোনে আব্বার সঙ্গে আলাপ হতো। বিদেশীরা বাংলাদেশ সম্বন্ধে কে কি বলেছে শুনতে চাইতেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
মাঝে মাঝে নাজিরপুর আসতেন। একদিন থেকেই আবার চলে যেতেন। প্রায়ই তার সঙ্গে থাকত আলী হায়দার। আব্বা ছেলেটিকে বড়ো পছন্দ করতেন।
আব্বার কিছু সময় আমাদের সঙ্গে থাকার ইচ্ছে থাকলেও থাকতে পারতেন না। পিরোজপুরের এস.ডি.ও রাজ্জাক সাহেব তাহলেই বলতেন, SDPO সাহেব আমাদের একা রেখে আপনি চলে গেলে আমরা কী করে থাকি?
একদিন বিকেলে খুব গোলাগুলির শব্দ শোনা যেতে লাগল। সন্ধ্যা হতেই দেখা গেল দূরে কোথায় লক লক করছে আগুন। আকাশ গাঢ় রক্তবর্ণ। খবর পেলাম ঝালকাঠি বাজার মিলিটারিরা পুড়িয়ে দিয়েছে। রাতে নাজিরপুরের o/c এসে অভয় দিতে চাইল আমাদের। বলল, ও কিছু নয় ও কিছু নয়, লাল মেঘ। আমরা সবাই কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম। এত কাছে মিলিটারি কখন পিরোজপুরে আসে কে জানে। খতমে ইউনুস পড়তে শুরু করলাম সবাই মিলে।
তার একদিন পরই নকশাল আর আওয়ামী লীগের ভিতর তিনঘণ্টাব্যাপী গুলি বিনিময় হলো পিরোজপুরে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে রেগুলার আর্মি, এক্স আর্মি, পুলিশ, আনসার আর কিছু নেভাল অফিসার। নকশালরাই কিন্তু জিতল অথচ এরা দলে মাত্র কুড়ি-পঁচিশজন। বন্দুক হাতে তারা সমস্ত শহরে আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগদের শহরের বাইরে বের করে দিলো। অথচ আওয়ামী লীগের হাতে তখন স্টেনগান, ব্রেটাগান, টমি গানের মতো অস্ত্র। নকশালদের সম্বল নাইট্রো গ্লিসারিনের হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা, যা তারা নিজেই তৈরি করেছে আর গোটা পনেরো রাইফেল।