এমনি সময় খবর এলো যশোহর sector পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে। চিটাগাং থেকে বাংলা বাহিনী সরে গিয়েছে। নেভির জোয়ানরা গানবোটে করে ঢুকে পড়েছে গ্রামের ভিতর। শেলবর্ষণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একটির পর একটি জনপদ। পরোক্ষভাবে অত্যাচারের চিত্র দেখতে পাচ্ছি। নদীর স্রোতের মতো লোক পালিয়ে আসছে খুলনা থেকে। তাদের দুঃখ-কষ্ট আর হতাশার কথা বর্ণনা নাই-বা করলাম।
রাতে ভালো ঘুম হয় না। বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখি। মাঝে মাঝে উড়োখবর আসে মিলিটারিজাহাজ হুলারহাটে ভিড়ছে। শুনে আতঙ্কে বুকের রক্ত জমে যায়। কি করা যায় ভেবে পাই না। শহরের লোকেরা। এস্তে ঘুরে বেড়ায়। অন্ধকার রাতি ভয়াবহ দুর্যোগের মতো বুকের ওপর চেপে বসে। আবার ভোর হয়, আবার আসে রাত্রি। এই বিভীষিকার মধ্যেও একটা আশার খবর পাওয়া গেল হঠাৎ। আকাশবাণীর প্রভাতী সংবাদে বলা হলো—‘সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগের্নি ইয়াহিয়ার কাছে ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়ে গণহত্যা বন্ধ করে রাজনৈতিক সমাধান করতে বলেছেন। বাংলার অবিসাংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা সম্বন্ধেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।’ আব্বা ঘুমিয়ে ছিলেন, তাকে ঘুম থেকে জেগে তুলে এই খবর শোনালাম। মুহূর্তে তার চোখমুখ থেকে দুশ্চিন্তার ছায়া অপসারিত হলো, বললেন—‘এইবার ইয়াহিয়া টাইট হবে। আর আমাদের ভয় নাই।’
পুরোনো স্মৃতির কথা লিখতে গিয়ে চোখ পানিতে ভরে ওঠে। একটা সুগভীর বেদনা অনুভব করি। প্রেসিডেন্ট পদগর্ণির চিঠিতে কোনো কাজ হয়নি। তবে আমাদের চরম হতাশায় বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে তারাই প্রথম খোলাখুলিভাবে আমাদের কথা বলেছে। তাদের সহানুভূতিটুকুতো পেয়েছি। তাই তাদের প্রতি আজ আমাদের অনেক ভালোবাসা, অনেক কৃতজ্ঞতা। জয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। জয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বীর জনগণ।
দু-দিন পরের কথা। রাত্রিকালীন ডিউটি সেরে ফিরছি। সঙ্গে আলী হায়দার, তার ভাগ্নে বাদশা, নকশাল গ্রুপের একটি ছেলে। রাত হবে আড়াইটা। দেখি বাসায় আলো জ্বলছে, বসার ঘরে অনেক লোকের ভীড়। আমাদের পায়ের শব্দে আব্বা বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে গেলেন, আয়, ভিতরে আয় বলে ডাকলেন। আলী হায়দারের দিকে ফিরে বললেন, হায়দার সাহেব একটা ব্যাপার হয়েছে, কাল আপনার সঙ্গে আলাপ হবে। আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল তার বুক থেকে একটা মস্ত বোঝা নেমে গেছে।
[লেখকের লেখা ৫০ নং পৃষ্ঠাটি হারিয়ে গেছে।]
কারণ আপনি যে আমাকে প্রাইভেট রিভলবার দিয়েছেন এটা সে জেনেছে এবং সে সন্দেহ করছে যে, রিভলবার দেয়া হয়েছে তাকে যুদ্ধ করার জন্যে। গেরিলা আরো বলল, আপনার ছেলে যে তার সঙ্গে রাতে গিয়েছে তাকেও হয়ত মেরে ফেলবে, আজ রাতেই মারবার কথা। আব্বা টেলিফোন ০.c. সাহেবের হাতে দিতে বললেন। দেওয়া হলে বললেন গেরিলাকে এরেস্ট করে রিভলবার আর গুলিগুলো রিকভার করতে। ০.c, জানাল মাত্র তিন রাউন্ডগুলি পাওয়া গেছে। বাকি গুলি নাকি সে প্র্যাকটিস করেছে। আম্মা বললেন নিশ্চয়ই সে গুলি করে কোনো মানুষ মেরেছে।
আমার মনের যে কি অবস্থা হলো তা আমিই জানি। সম্পূর্ণ ব্যাপারটার জন্যে আমিই দায়ী আব্বা আমাকে কিছুই বললেন না। রাতে এক ফোঁটা ঘুমও হলো না। সারারাত ছটফট করলাম, আর শুধু বললাম, আল্লা তুমি দয়া কর, এই নিয়ে আর যেন কোনো নতুন ঝামেলা না হয়। মনে ভয় এই বুঝি বুলেটের আঘাতে মৃত একটি লাশ বেরিয়ে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি একটা লাশ পাওয়া গেল। খুনি গেরিলা। খুন করেছে ছুরি মেরে। তাকে গ্রেফতার করা হলো।
দেশের কথা বাদ দিয়ে তখন শুধু নিজেদের কথাই ভাবতে লাগলাম। আব্বার যাতে কোনো বিপদ না হয় শুধু সেই দোয়াই করতে লাগলাম। মনে আতঙ্ক এই বুঝি যে-কোনো কিছু বলে আব্বাকে জড়িয়ে ফেলে। শেষ পর্যন্ত মেজর জলিলের নির্দেশে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সুবাদার গেরিলাকে গুলি করে হত্যা করা হয় হত্যাপরাধে। গেরিলা কাহিনির যবনিকাপতন হলো। তার লাশ নিতে। কেউ এল না। শেষে আনসাররাই কবরখানায় কবর দিলো তাকে। পরদিনই কুকুর সেই লাশ তুলে ফেলল। গোস্তের টুকরা মুখে করে ঘুরে বেড়াতে লাগল শহরময়।
এই সময়ই পাকিস্তানবাহিনী নির্বিচার বোমাবর্ষণ করে চলল, বগুড়া, সিলেট, চিটাগাং, ময়মনসিং, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, কুষ্টিয়া আর দিনাজপুরে। স্বাধীংলা বেতার স্তব্ধ, স্রোতের মতো লোক আসছে খুলনা থেকে, এই স্রোতেই এসে পড়লেন রহুল মামা তার ভাবিকে নিয়ে। আব্বা খুশি হয়ে বললেন, এসে পড়েছ তোমরা। যাক হাজার শুকুর একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমাদের নিয়ে। অসংখ্য খবর শুনলাম তাঁর কাছ থেকে, যেগুলো তিনি সযতনে ডাইরিতে লিখে রেখেছেন। তার দু-একটা এই ধরনের :
বাবা একটু পানি দেবেন? ২৭ শে মার্চ আলমের আব্বা ঢাকা থেকে জয়দেবপুর যাচ্ছেন। রাস্তায় অসংখ্য মৃতদেহ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। আর ভিতর থেকে এই কথা কটি একজন আহত আলমের আব্বাকে লক্ষ্য করে বলল। তিনি পানি না দিয়েই পালিয়ে আসলেন। কারণ মিলিটারিরা তার দিকে তাকিয়েছিল এবং তারা চায়না বাঙালি বাঙালিকে দয়া করুক।
খুলনার একটি মসজিদে ক-জন লোক নামাজ পড়ছিল। বাইরে গোলমালের শব্দে বেরিয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট উড়ে আসে তাদের ওপর। ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান।