প্রথম দিককার কথায় ফিরে আসি। আমাদের সাফল্যের প্রথম দিনগুলোতে যখন স্বাধীন বাংলা বেতার, কলকাতা বেতার, BBC, VOA, আর রেডিও অস্ট্রেলিয়া একটির পর একটি সাফল্যের খবর দিচ্ছে, ঠিক তখনই একটা খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। টিক্কা খান ইজ ডেড। টিক্কা খান হ্যাস গন। খবরটা এসেছে মগবাজার থেকে চাঁদপুর টেলিফোনে। টেলিফোন অপারেটররা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিল। থানায় আব্বাই প্রথম এ-খবর রিসিভ করে খুশিতে নাকি ‘জয় বাংলা’ বলে লাফিয়ে উঠলেন। মস্ত মিছিল বেরুল ই.পি. আর এর গুলিতে টিক্কা খান মরেছে। দু-একজন গরিব-দুঃখীদের পয়সা বিলালো এই উপলক্ষে। বিকেলের দিকে টিক্কা খানকে কীভাবে মারা হলো সে সম্বন্ধে অদ্ভুতসব গল্প নাজিম ভাই আনতে লাগলেন–
‘ই.পি. আর এর মেজর আব্দুল গফুর মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে সটান ঢুকে পড়েছিল টিক্কা খানের কনফারেন্স রুমে। ঢুকেই গুলি। সে নিজেও আর বেরিয়ে আসতে পারে নাই।’
BBC থেকেও যখন বলা হলো টিক্কা আহত। তখন টিক্কার মৃত্যু সম্বন্ধে সবাই নিঃসন্দেহ হয়ে বুকে হাতির বল পেল।
বাঙালির প্রতিরোধে ভাঙন ধরল ক্রমে। আকাশপথে জলপথে সৈন্য আসতে লাগল। যুদ্ধজাহাজ ইফতিখার আর বাবর থেকে ক্রমাগত শেল বর্ষিত হতে লাগল। বাঙালি অধিকৃত বন্দর চাটগাঁয় স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে মুহুর্মুহু বিদেশের বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাছে সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন জানানো হতে লাগল। বলা হতে লাগল যার যা অস্ত্র আছে নিয়ে এগিয়ে আসুন। এমনকি খুন্তি, দা, কুড়াল, মরিচের গুঁড়া। শুনতে শুনতে দুঃখে চোখে পানি এসে যায়, ভাবি কতটুকু অসহায় হলেই না এমন বলা যায়।
পিরোজপুরের কথা বলতে গেলেই আরেকজন এর কথা বলা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সে হচ্ছে প্রাক্তন সামরিক বাহিনীর একজন গেরিলা যুদ্ধের trainee. তার নাম (নাম সম্ভবত হাশেম) মনে নেই। এইখানে তাকে গেরিলা বলেই উল্লেখ করব। লোকটার গড়ন হালকা পাতলা, পেটা শরীর, চোখের তারা বেড়ালের মতো, বেশ লম্বা, গায়ের বর্ণ গাঢ় কালো। প্রথম থেকেই তার উন্মাদনা ছিল আকাশ ছোঁয়া। মুক্তিবাহিনীর সংগঠনে তাদের ট্রেনিং হওয়ানোয় সে মেশিনের মতোই। খাটছিল। তার ৬ জন বিশ্বস্ত অনুগামী নিয়ে সে একটা গেরিলা স্কোয়াডও করেছিল। সবার আস্থাও সে অর্জন করেছিল। কি করে তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দিচ্ছি।
সবাই ঘুমিয়ে রয়েছি, রাত হবে তিনটা। গেরিলা এসে কড়া নাড়ল। দরজা খুলে দিলাম আমি। কী ব্যাপার? ব্যাপার খুব গুরুতর। ট্রেজারি লুট করবার জন্যে আলী হায়দার নাকি তার দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আব্বা চিন্তিত মুখে তার বক্তব্য শুনছেন। সে বলে চলল, স্যার আমি ট্রেজারির পাশের রাস্তা দিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ আলী হায়দার আমায় হল্ট বলে থামাল। দেখি আলী হায়দার তার জনাকয় বন্ধু নিয়ে ট্রেজারির চারপাশে ঘুরঘুর করছে। আলী হায়দার বলল এ রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তায় যেতে। আমি অন্য রাস্তায় দৌড়ে আপনার কাছে এসেছি। আব্বা তার সিনসিয়ারিটির জন্য তার কাঁধে হাত রেখে তাকে ধন্যবাদ দিলেন। তারপর বললেন, আলী হায়দার ট্রেজারি রক্ষার জন্যেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে। আলাপ-আলোচনা করেই এটা ঠিক করা হয়েছে চিন্তার কিছু নেই। পরদিন ভোরে গেরিলা আবার এলো। বিষম উত্তেজিত। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িতে করে এসেছে। উত্তেজনার কারণ সে একজন স্পাই ধরে ফেলেছে। একে মেরে ফেলবে কি-না তাই নিয়ে পরামর্শ করতে এসেছে আব্বার সঙ্গে। আব্বা শুধু বললেন-এ যে স্পাই বুঝলেন কী করে? এবার সে একটি প্রস্তাব করল। স্যার আপনারতো দুটো রিভলবার, একটা আমাকে দিয়ে দেন যদি তবে আমি গেরিলাযুদ্ধে কাজে লাগাতে পারি। আব্বা পরিষ্কার না বলে দিলেন। গেরিলা চলে গেল। আমার মনে হলো কাজটা বুঝি ঠিক হলো না। আব্বাকে বললাম, সমস্ত রাইফেল যখন তাদের হাতে তখন বাড়তি একটা রিভলবার কি আর ক্ষতি করবে। সে গেরিলা ফাইটার। রিভলবার সত্যিকার অর্থেই সে কাজে লাগাতে পারবে, দুটো রিভলবারেরও আপনার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া ওদের হাতেই ক্ষমতা কাজেই সম্প্রীতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে এদের হাতে রাখা কর্তব্য। আব্বা আমার যুক্তিতে টলে গিয়ে গেরিলাকে ডেকে পাঠিয়ে নিজের Personal রিভলবার ৬ রাউন্ড গুলি দিয়ে দিলেন। এবং তার চাকরি জীবনে অন্যের কথা শুনে এই প্রথম হয়ত একটা বড় ধরনের ভুল করলেন। কেন সে কথা পরে বলছি।
এদিকে শেখ মুজিবের গ্রেফতার নিয়েও তুমুল হইচই হচ্ছে। স্বাধীন বাংলা বলছে তিনি গ্রেফতার হননি, তিনি সমগ্র মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করছেন। আকাশবাণী বলছে ২৫ শে মার্চের পরেও বিভিন্ন বেতার থেকে তার কণ্ঠ শোনা গিয়েছে। BBC-র একজন জাপানি সাংবাদিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলল তিনি হয়ত-বা গ্রেফতার হন নি। বহুরকম গুজব শোনা যায় তার সম্বন্ধে। কেউ বলছে আই বি ব্রাঞ্চের আই, জি আগেই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে তাকে সরিয়ে ফেলেছে। কেউ বলছে দু-জন বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর রাত ৯টার দিকে তাকে নিয়ে সরে পড়েছে। যদি সাংবাদিক গ্রিনের কথা অনুযায়ী শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়েছেন এবং বলেছেন তাঁর প্রতিবেশীকে যে ‘আমি যদি ধরা না দেই তবে আমার খোঁজে সমস্ত ঢাকা তছনছ করে ফেলবে, এরচে গ্রেফতার হওয়াই ভালো।’