থানা আর টাউন আউট পোস্ট থেকে একজন দুইজন করে পুলিশ সরতে থাকল। আব্বা কী করবেন ভেবে পেলেন না। বরিশালের এস.পি জানালেন ওয়ারলেস করে সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ মেনে চলেন।
পিরোজপুরে তখন চরম বিশৃঙ্খলা। রাইফেল হাতে ছেলেরা যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। দোকানপাট থেকে জোর করে জিনিসপত্র নিয়ে। আসছে। চাঁদা উঠানো হচ্ছে বড়ো হাতে। ডাকাতি শুরু হয়েছে। আসেপাশের গ্রামগুলোতে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে নকশালদের বিরোধ ধূমায়িত হচ্ছে। নেতৃত্বের চিহ্ন নেই কোথাও। বন্দুক হাতে পেয়ে সবাই নেতা। অবস্থার অবনতি হচ্ছে দ্রুত গতিতে। বিশেষ করে নকশাল-আওয়ামী লীগ বিরোধ। আওয়ামী লীগ বলছে দু-দলের উদ্দেশ্য যখন এক তখন এক সঙ্গেই আসুক তারা। নকশালদের কথা হলো আমাদেরটা আমরাই দেখব। তারপর নকশালরা যা শুরু করল তা মুক্তিসংগ্রামকে বহুলাংশে ক্ষতি করল। টাকাপয়সা, পেট্রল, কেরসিন, চাল, ডাল, তেল, মশলা ইত্যাদি যার কথাই মনে হতে লাগল তাই তারা জমাতে লাগল পর্বতপ্রমাণ। সমস্তই বন্দুক দেখিয়ে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠল সবাই। সরকারি অফিসাররা হলো তাদের খেলার পুতুল। বন্দুক হাতে তাদের দিয়ে যা ইচ্ছা তা করাতে লাগল। একটা উদাহরণ দিচ্ছি–
রাত ন টার দিকে একদল নকশাল ছেলে হাজির হলো বাসায়। তাদের সবার হাতেই রাইফেল। কী চাই? আব্বাকে দরকার। আব্বা বেরিয়ে এলেন।
ফজলু : চাচাজান (আব্বাকে চাচা ডাকত তাদের সবাই) আমরা একটা জরুরি কাজে এসেছি আপনার কাছে।
আব্বা : কী কাজ?
ফজলু : আপনি আমাদের একটা প্রাইভেট টেলিফোনের ব্যবস্থা করে দেবেন আর আপনাদের যে-ওয়ারলেসটা আছে সেটা আমাদের দিয়ে দেবেন।
আব্বা : বল কী?
ফজলু : চাচাজান সেটি আপনাকে করতেই হবে।
যাই হোক শেষ পর্যন্ত আব্বা ওদের একটা প্রাইভেট টেলিফোনের ব্যবস্থা করে দিলেন ইঞ্জিনিয়ার T & T-কে বলে। ওয়ারলেসটা অবশ্য রয়ে গেল।
যাই হোক বন্দুক হাতে ছেলেদের প্রথম যারা সংঘবদ্ধ করল তাদের মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের 2nd লেফটেন্যান্ট জিয়া আর একজন নেভাল অফিসারের দান খুবই বেশি। বেসামরিক দিক থেকে সাহায্য করলেন আলী হায়দার খান আর তরুণ ফোর্থ অফিসার মিজানুর রহমান।
Training camp খোলা হলো। সুসংঘবদ্ধ করে সত্যিকার অর্থেই ভালো Training দেয়া হলো। কিন্তু ইতিমধ্যে বড় দেরি হয়ে গেছে। ডাকাতের দল বন্দুকহাতে গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। খুন তখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।
আলী হায়দার খানের নেতৃত্বে মহকুমার অভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষার জন্যে একটা কমিটি গঠন করা হলো। তারা গ্রামে গ্রামে শান্তি রক্ষার জন্যে রক্ষিবাহিনী গঠন করে বেড়াতে লাগল। তাদের যাতায়াতের জন্যে ছিল পুলিশের মোটরবোট। সে দলটা বেরুত তাদের মধ্যে ছিল। আলী হায়দার, কোর্ট ইন্সপেক্টর, দু-জন আর্মড কনস্টেবল, আলী হায়দার এর ভাগ্নে বাদশা এবং আমি বলতে বাধা নেই ব্যাপারটা হতো একটা প্লেজার ট্রিপ। স্পিড বোটে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে চমৎকার লাগত। অবশ্য এই বেড়ানোর একটা মহৎ উদ্দেশ্যও ছিল সেটি হলো গ্রামবাসীকে এই স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্বন্ধে অবহিত করা।
দেখলাম হিন্দুদের ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয়েছে। সমস্ত বড়ো বড়ো হিন্দুবাড়ি ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে। ডাকাতি ছাড়া আরো অনেক কুৎসিত ব্যাপারও হচ্ছিল। উঠোনে হ্যাজাক জ্বালিয়ে কমবয়সী মেয়েদের তার চারদিকে ন্যাংটো করে দাঁড়া করে রাখা থেকে শুরু করে, সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া ছিল খুবই কমন।
রাতের বেলা শহরও পাহারা দিতে হতো। ছয় জনের একটা গ্রুপ করে বন্দুক হাতে শহরে টক্কর মারতে হতো। এই পাহারার ব্যাপারটা আমার বেশ লাগত। নির্জন শহর ঘুমিয়ে, আমরা ক-জন জেগে জেগে অচেনাসব রাস্তা-ঘাটে হাঁটছি। স্নান জোছনা পড়েছে শহরে, বাতাসে নারিকেলের পাতা কাঁপছে। অল্প শীত বেশ লাগত।
শিখু কেন জানি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সমস্ত দিন পড়ে পড়ে ঘুমাত। তার অবস্থা দেখে আব্বা শঙ্কিত হয়ে ডাক্তার ডাকালেন, অষুধ পত্র কেনা হলো। অথচ আব্বা নিজেও খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। খেতে পারতেন না, রাতে ঘুমুতে পারতেন না। অতি সামান্য খবরেও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। মনে আছে আকাশবাণী থেকে সাড়ে আটটায় অধ্যাপক সমর গুহ যখন বলছিলেন–
‘… বাঙালির একটি মাত্র অপরাধ, বাঙালি চেয়েছে, স্বাধীকার। জনগণ-মন অধিনায়ক শেখ মুজিব বলেছেন বঞ্চিত মানুষের কথা…’
অতি সাধারণ আবেগের কথা, তবু তাই শুনে আব্বার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল।
আম্মা কিন্তু খুব নিশ্চিন্ত ছিলেন। তিনি বলতেন সব যাই হোক, আমাদের কিছু হবে না। তিনি খুব দৃঢ়তার সঙ্গেই এ-কথা বলতেন এবং আমরা তার কথা আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করতাম। তার কারণও ছিল। আম্মার ক্ল্যারিওভ্যানসি ক্ষমতা কিছু পরিমাণে ছিল। ভবিষ্যতের প্রায় ঘটনাই আগেআগে টের পেতেন। আগেও অনেকবার তার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে আমাদের বিস্মিত করেছেন। তার। একটা উদাহরণ এখানে দিচ্ছি।
আম্মা দুপুরে পানটান খেয়ে পালঙ্কে বসে আমাদের সঙ্গে গল্প করছেন। বলছেন, গত রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। একটা বাচ্চা মেয়ে আমাকে এসে বলছে আমাকে চিনছেন না? আমি রাবেয়ার মেয়ে। আপনাদের এখানে থাকব কয়দিন। বলা শেষ হতেই পর্দা সরিয়ে বাচ্চা মতো একটা মেয়ে ঢুকে বলল সে রাবেয়ার মেয়ে, এখানে কয়েকদিন থাকত এসেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। এমনকি এই ক্ষমতার জন্যেই তার ওপর আমাদের বিশ্বাস ছিল প্রখর। তাঁর সম্বন্ধে আরো একটি কথা বলবার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি কোথাও কিছু নয় অথচ খুব মিষ্টি। ফুলের গন্ধ পেতেন। আমার ছোটোবোন শেফুও তা পেত। তাদের দু-জন সম্বন্ধে এইটুকু কথা বলা চলে যে, দু-জনই চূড়ান্ত রকমের ধর্মনিষ্ঠ। ধর্মের সব অনুশাসনই যে শুধু গভীরভাবে বিশ্বাস করত তাই নয়, যথাযথ নিষ্ঠার সঙ্গে পালনও করত।