সেই রাতেই খেয়া বন্ধ করতে লোক ছুটল যাতে খেয়া পার হয়ে মিলিটারি বাগেরহাট দিয়ে না আসতে পারে। লোক ছুটল রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে। রশীদও তাদের দলে ভীড়ে পড়ল। কোলাহল আতঙ্ক আর হতাশার মধ্যে ভোর হলো। রেডিও ধরল সবাই। কই কিছু নেই, একটানা সেতার বেজে চলছে। আতঙ্কিত লোকজন আকাশবাণী শুনতে চেষ্টা করল। সেখানে রীতিমত প্রভাতী অনুষ্ঠান চলছে। এত সব যে হয়ে যাচ্ছে তার কোনো খবর নেই।
সকাল দশটায় সামরিক নির্দেশাবলি প্রচারিত হলো। ইয়াহিয়া ভাষণ দিলেন এগারোটায়–
‘…শেখ মুজিবকে বিচর্বিচারে আমি ছেড়ে দেবো না। আওয়ামী লীগ দেশের শত্রু। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলাম। এবং আমার দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী তাদের পূর্ব সুনাম অক্ষুন্ন রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে এগিয়ে এসেছে…’
চারিদিক থমথম করছে। আতঙ্ক বুকের ওপর চেপে বসেছে। এই বুঝি মিলিটারি এসে পড়ল। আব্বা হতবুদ্ধি, S.P. বরিশাল নিশ্রুপ। পাকিস্তান রেডিও থেকে তখন অনবরত নাত-এ রসুল আর হামদ প্রচারিত হচ্ছে।
দুপুরে আচ্ছন্নের মতো বসে রয়েছি ট্রানজিসটার হাতে। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। কলকাতা স্টেশন ধরে রেখেছি। হঠাৎ সেখান থেকে গীতিকা অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ রেখে হঠাৎ বলা হলো পূর্ব বাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস, পূর্ব বাংলা রেজিমেন্ট, পূর্ব-পাকিস্তান পুলিশ, পূর্ব-পাকিস্তান আনসার, পূর্ব-পাকিস্তান মুজাহিদস দুর্জয় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছে। তারপর বাজান হলো সেই বিখ্যাত গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’
বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ ওয়ারলেস থেকে বলা হলো EPR-এর জোয়ানরা এখানে প্রচুর মিলিটারি মেরেছে বন্দি করেছে আরো অনেক। তারা এগিয়ে চলেছে কুমিল্লার দিকে। আরো খবর পাওয়া গেল তুমুল লড়াই চলছে কুমিল্লায়, চিটাগাং-এ। আচ্ছন্নের মতো কাটল আরো একটি দিন। ২৮ তারিখ রাতে রেডিওর নব ঘুরাচ্ছি যদি কোন বিদেশি স্টেশন কিছু বলে হঠাৎ শুনতে পেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। শরীরের সমস্ত রক্ত উত্তেজনায় ফুটতে লাগল। বাইরে তখন তুমুল উত্তেজনা, তুমুল হইচই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার। স্বাধীন বাংলা বেতার।’ অল্প সময়ের অনুষ্ঠান অথচ আগুন দিয়ে ঠাসা।
‘… ওরা জানে না আমরা কি চিজ। জানে না EPR কি জিনিস? আমরা ওদের টুটি টিপে ধরেছি। তুমুল যুদ্ধ চলছে। জয় আমাদের সুনির্দিষ্ট। এই ছোট্ট অনুষ্ঠানটা বাঙালিদের চরম আর ভয়াবহ হতাশায় কি আনন্দের সওগাতই না এনে দিলো। আব্বার অর্ডারলি নাজিমত কেঁদেই ফেলল আনন্দে। রেডিও centre-টা কোথায় তাই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। ঘোষকের বাড়ি কোথায় তাই নিয়ে বাজি ধরাধরি। কেউ বলছে নোয়াখালি কেউ বলছে সিলেট। মিছিল বের হয়েছে ‘স্বাধীন বাংলার জয়’ ‘জয় বাংলার জয়।’
খুলনা শহরের অদ্ভুত সব খবর পাচ্ছি। কারা তৈরি করেছে সেসব কে জানে তবে তা থেকে পরিস্ফুটিত হচ্ছে একটা জিনিস তা হলো বাঙালি জাতীয়তাবোধ। খবরগুলো আনে নাজিম। হাসিহাসি মুখে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবটা এই রকম যে একটা খবর জানি তবে মরে গেলেও বলব না। আমরা জানতে চাই কী খবর নাজিম ভাই তখনই হাত পা নেড়ে নাজিম ভাইয়ের খবর বলা শুরু হয়। দু একটা খবর এই ধরনের :
১। খুলনা শহরের সদর রাস্তায় কে যেন একবস্তা অড়হড়ের ডাল ঢেলে ফেলে দিয়েছে। ফলস্বরূপ মিলিটারি যখন পার হতে যাচ্ছে। তখনই পা পিছলে আলুর দম।
২। ট্রেঞ্চে বসে গুলাগুলি চলছে। একদিকে পশ্চিমা মিলিটারি অন্যদিকে বাঙালি ই.পি.আর। ফায়ার ব্রিগেডের লোকরা তক্কে তকে ছিল হোস পাইপ দিয়ে দিয়েছে মিলিটারির ট্রেনে পানি ভরতি করে। মিলিটারিগুলি হাঁসফাঁস করে মরছে।
৩। একদল মিলিটারি যাচ্ছিল রাস্তা বেয়ে। পথে নজর পড়ল এক ভিমরুলের চাকের ওপর। এটা কী রে বাবা? বোমা নয়তো? মারল সেখানে এক গুলি। ঝাঁকে ঝাঁকে ভিমরুল উড়ে এলো। ফলস্বরূপ তিন মিলিটারি খতম এর ভেতর দুজন আবার মেজর।
ঠিক এই সময় আওয়ামীলীগ নেতার বিবেচনায় একটা বড়ো ভুল হলো। পিরোজপুর ট্রেজারি থেকে আড়াই শত রাইফেল লুট হয়ে গেল। যার সুদুরপ্রসারী কুফল আওয়ামী লীগ নেতারাই দেখে গেলেন। পুলিশের সঙ্গে সম্পর্কও খারাপ হয়ে গেল জনসাধারণের। আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে মহকুমা পুলিশ প্রধান হিসেবে মতভেদ হয়ে গেল আব্বার।
রাইফেলগুলো ছিল আনসারদের। ঠিক হয়েছিল সে-সব আনসারদের দিয়ে দেওয়া হবে। সেই সমস্ত আনসারদের, যারা সত্যিকার অর্থেই যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। তাদের পাঠানো হবে বাগেরহাটে। সারা রূপসার তীরে যে-EPR দলটা আছে তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে খুলনার মিলিটারিদের উপর আক্রমণ চালাবে। স্থানীয় পুলিশ, বিভিন্ন থানা থেকে পুলিশ এনে নিজেদের ঘাঁটি সুরক্ষিত করে রাখবে যাতে মিলিটারি আক্রমণের সমুচিত জবাব দেওয়া যায়। এইরূপ আলাপ আলোচনা যখন চলছে ঠিক তখনি আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য এনায়েত হুসেন শ তিনেক লোক নিয়ে ট্রেজারি ঘেরাও করলেন। ১৬ জুন armed police যারা ট্রেজারি দিন রাত পাহারা দিত তারা কী করবে ভেবে পেল না। আব্বা দৌড়ে গেলেন সেখানে বললেন, এইভাবে রাইফেল ডাকাতের হাতে পড়ে মহা মুশকিল হয়ে যাবে। বন্দুক আমরাও ধরব। আমাদের বিশ্বাস করো তোমরা। রাইফেল লুট হয়ে গেল। এবং সেই দিনই পঞ্চাশের বেশি রাইফে আর দুই হাজার রাউন্ড গুলি চলে গেল ডাকাতের হাতে। এবং বলা বাহুল্য এর ফল পরখ করল সবাই। আওয়ামী লীগের এই ভুল চালে পুলিশ সবাই ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল। ট্রেজারি গার্ডের ১৬ জন পুলিশের মধ্যে দশ জন armed police পালিয়ে গেল পরদিনই।